ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্বের শবদেহ কাঁধে এক জেনারেল ও তার নীরব সেনাবাহিনী

ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্বের শবদেহ কাঁধে এক জেনারেল ও তার নীরব সেনাবাহিনী। Waker-Uz-Zaman A General Carrying the Corpse of Responsibility, and His Silent Army. ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্বের শবদেহ কাঁধে এক জেনারেল ও তার নীরব সেনাবাহিনী। Waker-Uz-Zaman A General Carrying the Corpse of Responsibility, and His Silent Army.

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: ২০২৪ সালের আগস্ট মাস বাংলাদেশের আকাশে এক অদ্ভুত আঁধার হয়ে নেমে আসে। সেই আঁধারের ঠিক কেন্দ্রে, ৫ তারিখে, জাতির সামনে মঞ্চে প্রবেশ করলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। ধীর, স্থির এবং শেক্সপীয়রীয় নাটকের নায়কের মতো গম্ভীর গলায় তিনি ঘোষণা দিলেন, দেশের জানমালের দায়িত্ব এখন থেকে তার কাঁধে। তার সেই কণ্ঠস্বর টেলিভিশনের পর্দায় এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হলো, যেন এক মহাকাব্যিক নাটকের প্রথম অঙ্ক শুরু হতে চলেছে। সাধারণ মানুষ, যারা ততদিনে আতঙ্কের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছিল, তারা খড়কুটোর মতো এই ঘোষণা আঁকড়ে ধরল। তারা ধরেই নিয়েছিল, এবার হয়তো ঘোর অমানিশা কেটে যাবে, মুক্তির ভোর আসবে। কিন্তু সেই গুরুগম্ভীর ঘোষণার পর যা শুরু হলো, তা কোনো বীরত্বগাথা নয়, বরং এক নির্মম কৌতুক যা জাতির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।

দায়িত্ব শব্দটি যেন সেনাপ্রধানের মুখ থেকে বের হয়েই সোজা জাদুঘরে চলে গেল। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অদ্ভুত নীরবতার ব্রত পালনে নিযুক্ত হলো, যা কোনো ধ্যানমগ্ন ঋষির তপস্যার চেয়েও কঠিন। তাদের এই নীরবতার প্রথম বলি হলো দেশের ইতিহাস। বাংলাদেশের জন্মের আঁতুড়ঘর, জাতির উত্থান-পতনের সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি যখন আগুনে পুড়ছিল, তখন সেনারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের ভাবলেশহীন মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, তারা কোনো জাতীয় বিপর্যয় দেখছে না, বরং মনোমুগ্ধকর আতশবাজির উৎসব উপভোগ করছে। আগুনের লেলিহান শিখা যখন ইতিহাসের প্রতিটি পাতাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছিল, তখন সেনারা যেন সেই ধোঁয়া গণনা করছিল। দায়িত্ব নেওয়ার এমন অভিনব ও পরাবাস্তব সংজ্ঞায় পুরো জাতি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো দেশজুড়ে ইতিহাস ধ্বংসের এক পরিকল্পিত উৎসব। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো যখন একে একে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন সেনারা হয়ে উঠল সেই ধ্বংসযজ্ঞের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পাহারাদার। তাদের নীরবতা যেন এক অলিখিত অনুমোদন। সেই নীরবতা চিৎকার করে বলছিল, “ভাঙো, তোমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আমরা পাহারায় আছি।”

এই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে মঞ্চে আনা হলো দেশের বীর সন্তানদের। মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় পরানো হলো জুতার মালা। যারা একদিন দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, তাদেরকেই করা হলো চরম অপমান। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছে ফেলার এক অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল দুর্বৃত্তের দল। অথচ যে সেনাবাহিনীর জন্মই হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা থেকে, যাদের প্রতিটি সদস্য দেশের সংবিধান ও সম্মান রক্ষার শপথ নিয়েছেন, তারাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা ছিল সম্মতির চেয়েও বেশি কিছু; এটা ছিল এক ধরনের সক্রিয় সহযোগিতা।

এরপর এলো মানবিক বিপর্যয়ের পালা। গোপালগঞ্জের মতো জায়গায় যখন পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হলো, যখন দেশের নদীগুলো লাশের ভাগাড়ে পরিণত হলো, তখনো সেনাপ্রধানের ‘দায়িত্ব’ নামক শব্দটি গভীর শীতনিদ্রা থেকে জাগল না। তার সেই বিখ্যাত ঘোষণার পর মনে হচ্ছিল, জানমালের হেফাজত করার নতুন অর্থ হলো চোখ বুজে থাকা এবং হত্যাকাণ্ডের কোনো হিসাব না রাখা। সেনাবাহিনী যেন এক নতুন ধরনের দর্শন আয়ত্ত করেছে: যা কিছু ঘটছে তা অদৃশ্য, যা কিছু বলা হচ্ছে তা অশ্রুত।

এই করুণ নাটকের প্রধান চরিত্র সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান নিজেকে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার চোখেমুখে একজন ঝানু কূটনীতিকের ছাপ, কথায় শান্তির পায়রা ওড়ে, অথচ তার আচরণে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা। তিনি হয়ে উঠলেন ‘গম্ভীর মুখের নীরব শিল্পী’, ‘শান্তশিষ্ট ধ্বংসের প্রদর্শক’ এবং ‘নীরবতার দার্শনিক’। গণমাধ্যমের সামনে তার প্রতিটি উপস্থিতি ছিল এক একটি মাস্টারক্লাস। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যেন দেশে কিছুই ঘটেনি, সবকিছুই শান্ত। তার ভাষণগুলো ছিল সুন্দর শব্দে বোনা এক একটি ফাঁকা বুলি, আর তার সেনাবাহিনী ছিল সেই বুলির নীরব দর্শক। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এমনভাবে উত্তর দিতেন, যেন তিনি অন্য কোনো দেশের সেনাপ্রধান।

মানুষের শেষ আশার প্রদীপটুকুও নিভে গেল যখন তারা দেখল সেনাবাহিনী কোনো অন্যায় রুখছে না। তারা আশা করেছিল, সেনারা অন্তত একটি ‘মব’ আটকাবে, একটি ভাস্কর্য রক্ষা করবে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বাঁচাবে। কিন্তু সেনাবাহিনী করল ঠিক তার উল্টো। তারা তাদের নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে নিশ্চিত করল যেন ইতিহাস ধ্বংসের এই মহাযজ্ঞে কোনো ধরনের বাধা না আসে। তাদের এই ভূমিকা দেখে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তারা হানাদারদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং দেশের ভেতরে থাকা রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। হানাদাররা ভাঙছে, লুট করছে, হত্যা করছে আর সেনারা পাহারা দিচ্ছে, যেন তাদের এই পাশবিক আনন্দে কেউ বিঘ্ন ঘটাতে না পারে।

এখন জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই ‘দায়িত্ব’ শব্দের আসল মানে কী? দায়িত্ব নেওয়া মানে কি শুধু টেলিভিশনের পর্দায় এসে মিষ্টি ভাষায় জনগণকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা? নাকি দায়িত্ব মানে হলো একটা গোটা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সম্মানকে চোখের সামনে ছাই হতে দেখা? যদি দ্বিতীয়টিই সত্যি হয়, তবে বলতেই হবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের অর্পিত দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তারা এক মুহূর্তের জন্যও তাদের নীরবতার শপথ ভাঙেনি, এক মুহূর্তের জন্যও ধ্বংসের দৃশ্য থেকে চোখ সরায়নি।

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এর সেই ঐতিহাসিক ‘দায়িত্ব’ শব্দটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় তামাশা। আর তার সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত নীরবতা এক নতুন ধরনের জাতীয় লজ্জা। এই সেনাবাহিনী বন্দুক দিয়ে একটি গুলি না ছুড়েও একটি দেশকে ভেতর থেকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। তাদের নীরবতাই এখন সবচেয়ে বড় এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্র, যা দিয়ে তারা যেকোনো ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা আর অনাচারকে নীরবে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই নীরব সম্মতি বুঝিয়ে দিয়েছে, একটি সশস্ত্র বাহিনী কেবল আক্রমণ করেই নয়, নিষ্ক্রিয় থেকেও একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *