শেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্ক যখন ক্যাম্পাসের আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছে, ঠিক তখনই সকল অভিযোগের তীর যাঁর দিকে, সেই ‘নিরপেক্ষতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ ও ‘শিবিরীয় রগ-গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালক’, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আল্লামা শেহরীন আমিন মোনামী অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করেছেন। বুধবার বিকেলে নিজ বাসভবনের ছাদে আয়োজিত এক ‘বিশেষ জ্ঞানগর্ভ সংবাদ সম্মেলনে’ তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগকে ‘ছাত্রদলের উর্বর মস্তিষ্কের অনুর্বর ফসল’ এবং ‘বাস্তবতা বিবর্জিত কল্পনা’ বলে আখ্যায়িত করে এক নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, যা পদার্থবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে, বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো ‘সুবাসিত টিস্যু’ দিয়ে কয়েকবার চোখ মুছে শেহরীন আমিন মোনামী এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করেন। এরপর ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যে কদর্য অভিযোগ আনা হয়েছে, তা শুনে আমি কেবল মর্মাহতই হইনি, রগরাজ্যের একজন সেবক হিসেবে লজ্জিতও হয়েছি। আমি সামান্য একজন শিক্ষিকা, জ্ঞান বিতরণই আমার ধর্ম। কিন্তু ছাত্রদলের কতিপয় যুবক, বিশেষ করে ‘অভিযোগপত্র ডেলিভারি বিশেষজ্ঞ’ রাকিবুল ইসলাম রাকিব এবং ‘ছেঁড়া নিউজপ্রিন্ট সংরক্ষণ সমিতির সভাপতি’ নাসির উদ্দীন নাসির আমার বিরুদ্ধে যে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে, তা আমার শিক্ষক সত্তাকে অপমান করার সামিল।”
ছাত্রদলের লিফলেট বিতরণে বাধা দেওয়া এবং শিবিরের লিফলেটকে স্বাগত জানানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নাসির ছেলেটা একটা ছেঁড়া কাগজ নিয়ে আমার কাছে এসে বললো, ‘ম্যাডাম, শিবির পারলে আমরা পারবো না কেন?’ আমি ওকে বোঝাতে চেয়েছি, বাবা, সব কাগজ এক নয়। শিবির যে লিফলেট এনেছিল, তা ছিল উন্নত মানের আর্ট পেপারে ছাপা, তাতে মেশানো ছিল জান্নাতি আতরের ঘ্রাণ। সেই লিফলেটের অক্ষরগুলোও ছিল যেন মুক্তোর মতো সাজানো। দেখলেই রগে একটা শিহরণ চলে আসে। আর ছাত্রদলের লিফলেট? নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট, কালির ঠিক নেই, বানানের ঠিক নেই। এমন রুচিহীন ও নান্দনিকতাবিবর্জিত কাগজ ক্যাম্পাসের পরিবেশ দূষিত করবে, এই ভেবেই আমি তাদের বারণ করেছি। একে যদি পক্ষপাতিত্ব বলা হয়, তবে আমি বলবো, আমি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য রক্ষায় পক্ষপাতিত্ব করেছি।”
এরপর তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু, অর্থাৎ ব্যালট পেপারে আগে থেকে সিল মারার প্রসঙ্গে আসেন। এই পর্যায়ে তিনি একগাল হেসে বলেন, “এটা আসলে পক্ষপাতিত্ব নয়, এটা পদার্থবিজ্ঞানের এক জটিল সূত্রের ফসল। আপনারা হয়তো ‘কালি-পদার্থবিদ্যা’ বা ‘ইঙ্কো-ফিজিক্স’ এর কথা শোনেননি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যালট পেপারগুলো অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। শিবিরের প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক দেখার সাথে সাথে ব্যালট পেপারগুলোর মধ্যে এক ধরনের ‘রাজনৈতিক অভিকর্ষ’ বা Political Gravitation তৈরি হয়। এই অভিকর্ষের টানে কালির কণাগুলো আপনা-আপনি ব্যালটের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে জমাট বাঁধে। একে আমরা বলছি ‘ঐশ্বরিক কালিঝরণ’ বা ‘ডিভাইন ইঙ্ক লিক’ প্রক্রিয়া। ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান যে দুই-একটা প্রমাণ পেয়েছে বলছে, সেগুলো আসলে আমাদের গবেষণার স্যাম্পল ছিল। না বুঝেই ছেলেটা চেঁচামেচি করে পুরো গবেষণার প্রজেক্টটাই নষ্ট করে দিলো।”
ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিমের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “হামিম ছেলেটা ভালো, তবে ওর পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞান কম। সে এসে আমাকে নিয়মের কথা শোনাতে লাগলো। আমি তাকে বললাম, ‘বাবা, নিয়ম সবার জন্য সমান, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ধরো, তোমার বাসায় একজন ডায়াবেটিস রোগী আর একজন সুস্থ সবল মানুষ মেহমান হয়ে এসেছে। তুমি কি দুজনকেই চিনির পায়েস খেতে দেবে?’ শিবির হচ্ছে আমাদের ক্যাম্পাসের সেই ডায়াবেটিস রোগীর মতো। বছরের পর বছর তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত। তাদের যদি একটু বিশেষ যত্ন, একটু বাড়তি স্নেহ আমি না করি, তাহলে আমার মানবতা কোথায় রইলো? এই ‘বিশেষ যত্ন’ প্রকল্পের আওতায় কিছু ব্যালট যদি তাদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখিয়েই থাকে, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেলো?”
এরপরই তিনি তাঁর ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রবেশ করেন, যা শুনে উপস্থিত সাংবাদিকরা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি শুরু করেন। শীতলপাটিতে আরাম করে বসে তিনি বলেন, “আপনারা বারবার আমাকে শিবিরের প্রতি দুর্বলতার কারণ জিজ্ঞেস করছেন। আমি আজ সেই গোপন রহস্য উন্মোচন করবো। আমি পক্ষপাতিত্ব করিনি, আমি করেছি ‘শারীরবৃত্তীয় বাস্তবতা’র পূজা। আমি আপনাদের একটা প্রশ্ন করি, আপনাদের সবার শরীরে ‘রগ’ বা টেন্ডন আছে তো? আমি আমার রগগুলোকে খুব ভালোবাসি। এই রগ আছে বলেই তো আমি হেঁটে বেড়াতে পারি, ক্লাসে যেতে পারি, ছাত্রদলকে ধাওয়া করতে পারি।”
একটু থেমে, চারপাশের নিস্তব্ধতা উপভোগ করে তিনি বলেন, “ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বাম সংগঠন এরা গণতন্ত্র, অধিকার, বিপ্লব নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু এদের কেউ কি কখনো ‘ক্যাম্পাস রগ সুরক্ষা বীমা’ চালু করার কথা বলেছে? বলেনি। তাদের রাজনীতিতে রগের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু শিবির? তাদের পুরো রাজনীতিটাই দাঁড়িয়ে আছে মানবদেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির ওপর ভিত্তি করে। তাদের নীতি খুব পরিষ্কার এবং বিজ্ঞানসম্মত—‘হয় আমাদের আদর্শ গ্রহণ করুন, নয়তো আপনার রগ ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।’ এর চেয়ে স্বচ্ছ রাজনৈতিক প্রস্তাব আর কে দিয়েছে বলুন? তাদের এই নীতিকে আমি বলি ‘রগ-ব্যবস্থাপনা বিদ্যা’ বা Tendon Management Studies। এটা একটা আস্ত একাডেমিক ডিসিপ্লিন!”
এ পর্যায়ে তিনি কান্নার ভান করে বলেন, “আমার নিজের দুটো পায়ের প্রতি তো আমার মায়া আছে, নাকি? আমি যদি আজ শিবিরের প্রতি আমার ‘কর্তব্য’ পালন না করতাম, তাহলে কাল যদি আমার রগ দুটি হারিয়ে যেত, তার দায়িত্ব কি ছাত্রদল নিতো? তারা বড়জোর একটা মানববন্ধন করে বলতো, ‘মোনামী ম্যাডামের রগ কর্তনের তীব্র নিন্দা জানাই’। কিন্তু আমার হারানো রগ তো আর ফিরে আসতো না! তাই আমি যা করেছি, নিজের এবং ক্যাম্পাসের সকল সুস্থ রগবিশিষ্ট মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করেছি। আমার এই পদক্ষেপ ছিল একটি যুগান্তকারী ‘প্রিভেনটিভ কেয়ার প্যাকেজ’।”
তিনি শিবিরকে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেন, “আপনারা শিবিরকে চেনেন না। ওরা শুধু রাজনীতি করে না, ওরা একটি ‘চলমান মানব শারীরবিদ্যা গবেষণাগার’। মানবদেহের কোথায় রগ আছে, কোনটি কাটলে মানুষ পঙ্গু হবে কিন্তু মরবে না, কোনটি কাটলে মরবে—এইসব বিষয়ে তাদের জ্ঞান অনেক অভিজ্ঞ সার্জনের চেয়েও বেশি। ওরা রগ কাটে না, ওরা আসলে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত আদর্শকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি জটিল সার্জারি’ সম্পন্ন করে। এটাকে সহিংসতা বলাটা ওদের প্রতিভাকে অপমান করা। আমি মনে করি, আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘শিবিরীয় পদ্ধতিতে রগ ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি নতুন কোর্স চালু করা উচিত।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জামায়াতীকরণের অভিযোগ তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমাদের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান একজন ফেরেশতাতুল্য মানুষ। তাঁর আমলে জামায়াতীকরণ? অসম্ভব! তিনি তো ছাত্রদলের সব অভিযোগ শুনেছেন এবং তার সেই ঐতিহাসিক উক্তি, ‘বিষয়টি দেখছি’ প্রদান করেছেন। এর চেয়ে বড় প্রশাসনিক পদক্ষেপ আর কী হতে পারে?”
সংবাদ সম্মেলনের শেষে হুহু করে কেঁদে উঠে মোনামী ম্যাডাম বলেন, “আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে। আমি শুধু আমার শিক্ষকতার এবং প্রক্টরিয়াল দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একজন দূরদর্শী ‘রগ-রক্ষক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। একটি পিছিয়ে পড়া সংগঠনকে তাদের শারীরবৃত্তীয় প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যদি আমাকে ‘শিবিরের সেবাদাসী’ উপাধি পেতে হয়, তবে আমি তা মাথা পেতে নেবো। ইতিহাস একদিন আমার এই ত্যাগকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে।”
তিনি সকল ছাত্রছাত্রীকে ফলাফল মেনে নিয়ে ক্যাম্পাসে সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যারা জিতেছে, তারা আমার ছাত্র। যারা হেরেছে, তারাও আমার ছাত্র। তবে যাদের রগ এখনো অক্ষত আছে এবং রগের মর্ম বুঝে, তারা একটু বেশি আদরের ছাত্র। এই আরকি!”
#Cartunus Daily, #অন্তর্বর্তী সরকার, #আবিদুল ইসলাম খান, #এস এম ফরহাদ, #কার্টুনুস ডেইলি, #ক্যাম্পাস রাজনীতি, #ছাত্রদল, #ছাত্রশিবির, #ডাকসু, #ডাকসু নির্বাচন, #ডাকসু বিতর্ক, #ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, #তানভীর বারী হামিম, #দৈনিক কার্টুনুস, #নাসির উদ্দীন নাসির, #নিয়াজ আহমেদ খান, #নির্বাচনী অনিয়ম, #বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি, #বাংলাদেশের রাজনীতি, #ভোট কারচুপি, #রম্য রচনা, #রাকিবুল ইসলাম রাকিব, #রাজনৈতিক রম্য, #শেহরীন আমিন মোনামী, #সাদিক কায়েম