মবোক্রেসির জনকের বিলম্বিত বোধোদয়: ‘মবোক্রেসি আমাদের ব্যর্থতা, সামাল দেওয়া যায়নি’
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: রাজধানীর এক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে দাঁড়াইয়া তথ্য মহীরুহের নয়নযুগল যখন অশ্রুসজল হইয়া উঠিল, তখন উপস্থিত সুধীজনেরা যারপরনাই বিস্মিত হইলেন। দীর্ঘ চৌদ্দ মাস ধরিয়া দেশব্যাপী ‘মবতন্ত্র’ নামক এক অভিনব শাসনব্যবস্থা চালু করিয়া উহার বাম্পার ফলনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলিবার পর, তাহার এই আকস্মিক দুঃখবিলাস অনেককেই ধাঁধায় ফেলিয়াছে। করুণ সুরে তিনি বলিয়াছেন, ‘মবোক্রেসি আমাদের ব্যর্থতা, অনেক কিছু হয়তো আমরা সামাল দিতে পারিনি।’ এই একটি বাক্যের মাধ্যমে তিনি কি তাহার সাফল্যের চূড়া হইতে পতনের ভয়ে শঙ্কিত, নাকি ইহা আরও বড় কোনো নাটকের মহড়া, সেই আলোচনাতেই এখন চায়ের দোকান সরগরম।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ সাংবাদিক তাহার ডায়েরির পাতায় লিখিলেন, ‘নিজের হাতে রোপণ করা বিষবৃক্ষের ফল খাইবার পর এখন যদি কেহ বলেন, “ইহা তো বড়ই তিতা,” তবে তাহাকে সাধুবাদ জানানো যায় না।’
ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন অন্তর্বর্তী সরকারেরতথ্য মহীরুহ মাহফুজ আলম বলেন, প্রায় দেড় বৎসর পূর্বে দূরদর্শী রাষ্ট্রচিন্তক ও স্বাধীনতা স্বপক্ষের কাণ্ডারি সজীব ওয়াজেদ জয় ‘মবোক্রেসি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছিলেন, আর আজ নাকি সেই শব্দেই দেশ নিমজ্জিত। এই কথা শুনিয়া পেছনের সারির এক তরুণ কলামিস্ট ফিসফিস করিয়া বলিলেন, ‘দেড় বৎসর আগেই যখন ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়াছিলেন, তখন তাহার কথায় কর্ণপাত করা হয় নাই। আর এখন সেই ঝড়ে ঘরের চাল উড়াইয়া লইয়া যাইবার পর চালের মালিক হাহাকার করিয়া বলিতেছেন, “আহা! কী ভীষণ ঝড়!”’
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের কথা কে ভুলিতে পারে? যখন কিছু প্রশিক্ষিত জঙ্গি এবং ভাড়াটে টোকাই তথাকথিত ‘গণঅভ্যুত্থান’ মঞ্চস্থ করিয়াছিল। তাহাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি নির্বাচিত ও বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সেই উদ্দেশ্য সাধন করিতে, সাধারণ ছাত্র-জনতাকে আবেগাক্রান্ত করিয়া রাজপথে নামাইবার জন্য কিছু নিরীহ প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয় এবং সেই দায় তৎকালীন সরকারের ঘাড়ে চাপানো হয়। সেই ‘কৌশলগত হত্যাকাণ্ড’ এর ছবি ব্যবহার করিয়া কান্নার যে রোল উঠিয়াছিল, সেই কান্নার সুরেই রচিত হয় দেশের বর্তমান মবতন্ত্রের ভিত্তি। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া থাকা বাংলাদেশে গত চৌদ্দ মাসে আইনের শাসন এক নির্মল রসিকতায় পরিণত হইয়াছে। বিচারককে ছাড়াই বিচার কার্যকর করা এবং অভিযুক্তকে গণধোলাই দেওয়া এক প্রকার সামাজিক উৎসবে পরিণত হইয়াছে। এই উৎসবের অন্যতম পুরোধা হইয়া আজ তথ্য মহীরুহ মাহফুজ আলম যখন ‘ব্যর্থতা’র কথা বলেন, তখন তাহা যে কোনো মঞ্চাভিনেতার অভিনয়কেও হার মানায়।
তথ্য উপদেষ্টা আরও বলিয়াছেন, তাহারা নাকি গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেন নাই, কিন্তু গণমাধ্যমের ‘দায়িত্বশীলতা’ খুঁজিয়া পাইতেছেন না। কারণ কিছু গণমাধ্যম নাকি বারবার এক বিশেষ ‘আখ্যান’ বা ‘বয়ান’ চালাইতেছে। এই কথা শুনিয়া এক সাংবাদিক নিজের খাতায় টোকা রাখিলেন, ‘তার মানে, উনাদের তৈয়ারি করা “আখ্যান” বাদ দিয়া অন্য কেহ নিজেদের “আখ্যান” চালাইতেছে, ইহাই উনার মূল আপত্তির জায়গা।’
তবে মহাজ্ঞানী উপদেষ্টা ইহার সমাধানও দিয়াছেন। তিনি নাকি একদিন সরকারে থাকিলেও নতুন গণমাধ্যমের অনুমোদন দিয়া যাইবেন। কারণ তিনি ‘বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্যের লড়াই’ দেখিতে চান। উপস্থিত এক সমাজবিজ্ঞানী মন্তব্য করেন, ‘বিষয়টা হইলো, পুরাতন ভাড়াটে খেলোয়াড়েরা গোল দিতে পারিতেছে না দেখিয়া এখন নতুন খেলোয়াড় মাঠে নামানোর বন্দোবস্ত চলিতেছে। খেলার নিয়মকানুন সব একই থাকিবে, শুধু জার্সি বদলাইবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, চৌদ্দ মাস ধরিয়া মবতন্ত্রের যাঁতাকল চালাইবার পরেও যখন দেখা যাইতেছে যে স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিরোধের কারণে দেশটাকে পুরোপুরি দেউলিয়া বানানো যাইতেছে না, তখনই এই বিলম্বিত আত্মোপলব্ধির নাটক শুরু হইয়াছে। এখন তিনি নিজেই মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে একজন সোচ্চার সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে চাইছেন। ইহা অনেকটা যিনি আগুন লাগাইয়াছেন, তাহারাই এখন দমকল বাহিনীর প্রধান সাজিয়া আগুনের ভয়াবহতা বর্ণনা করিতেছেন।
সবশেষে বলা যায়, একই অনুষ্ঠানে ‘বাংলা ফ্যাক্ট’ নামক একটি সত্য-মিথ্যা যাচাইকারী ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হইয়াছে। দেশের সাধারণ মানুষ আশা করিতেছে, এই ব্যবস্থাটি সর্বপ্রথমে তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করিয়া জাতির সামনে তুলিয়া ধরিবে।