মরিয়ম মান্নানের ভাবশিষ্য! গাজীপুরের খতিব মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর স্ব-অপহরণ নাটকে নতুন মাত্রা।
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: দেশজুড়ে তোলপাড়। চায়ের কাপে তুমুল ঝড়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্ব-অপহৃত হজরত আল্লামা মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজী। গাজীপুরের পূণ্যভূমি থেকে অন্তর্ধান হয়ে সুদূর পঞ্চগড়ে পায়ে শিকলসহ আবির্ভূত হওয়ার যে অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্য তিনি রচনা করেছেন, তা দেশের নাট্যজগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে এই নাটকের পেছনে এক মহীরুহের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন দেশের বিজ্ঞজনেরা। অনেকেই বলছেন, এ নিছক একটি একক অভিনয় নয়, বরং এটি একটি গুরু-শিষ্য পরম্পরার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সেই গুরু অন্য কেউ না, তিনি স্ব-অপহরণ নাট্যশাস্ত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী, খুলনার কীর্তিমান কন্যা মরিয়ম মান্নান।
ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজী বেশ কিছুদিন ধরেই নিজের সাদামাটা জীবনে একঘেয়েমি অনুভব করছিলেন। এলাকার মুসল্লিদের বয়ান করে আর মন ভরছিল না। তিনি এমন কিছু করতে চাইছিলেন যা তাকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি এনে দেবে। এমন সময় তার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত তাকে ‘মরিয়ম মান্নান সমগ্র’ গ্রন্থটি উপহার দেন। দিনরাত এক করে সেই গ্রন্থ পাঠ করে হজরত মিয়াজী আত্মগোপন ও স্ব-অপহরণের প্রেমে পড়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, এই শিল্পে তার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কালবিলম্ব না করে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তী মরিয়ম মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মরিয়ম মান্নান প্রথমে কিছুটা অনাগ্রহ দেখালেও, মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর শেখার অদম্য ইচ্ছা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মুফতি মিয়াজীকে তার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ স্ব-অপহরণ ও অন্তর্ধান কলাকেন্দ্র’-এর ছাত্র হিসেবে ভর্তি করে নেন। শুরু হয় নিবিড় প্রশিক্ষণ।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিকে দেওয়া এক গোপন সাক্ষাৎকারে স্ব-অপহরণ কলাকেন্দ্রের ঝাড়ুদার মতলব মিয়া জানান, “গুরুমাতা (মরিয়ম) আর শিষ্য (মিয়াজী) ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতেন। গুরুমাতা শেখাতেন কীভাবে নিখোঁজ হতে হয়, কীভাবে কান্নার অভিনয় করতে হয়, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করতে হয়। একদিন দেখি, গুরুমাতা শিষ্যকে বকাঝকা করছেন। তিনি বলছিলেন, ‘আপনার আবেগ আসছে না, মিয়াজী সাহেব! আপনার কান্নায় দরদ নেই। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে পেঁয়াজ কেটে চোখে জল এনেছেন। আমার মায়ের নিখোঁজ হওয়ার পরের আমার ফেসবুক পোস্টগুলো দেখুন, আমার কান্নার ছবি গুলো দেখুন, শিখুন!’”
প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘শিকলতত্ত্ব’। মরিয়ম মান্নান তার শিষ্যকে হাতে-কলমে দেখিয়েছিলেন, শিকলের আকার, ওজন এবং বাঁধার শৈলী কতটা নান্দনিক হতে পারে। মতলব মিয়া আরও জানান, “গুরুমাতা বলছিলেন, ‘শিকলটা যেন খুব বেশি ভারি না হয়, আবার একেবারে হালকাও যেন না লাগে। পায়ে এমনভাবে জড়াতে হবে যেন মনে হয় অত্যাচার করা হয়েছে, কিন্তু নিজের হাঁটতেও যেন কষ্ট না হয়। আর হ্যাঁ, তালার চাবিটা অবশ্যই নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।’”
প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে। চিত্রনাট্য অনুযায়ী, মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজী গাজীপুর থেকে উধাও হবেন এবং তাকে ‘অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা’ রোগী বহনকারী গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু বিপত্তি বাধে এখানেই। হজরত মিয়াজীর বাজেটে কুলাচ্ছিল না। একটি ব্যক্তিগত রোগী বহনকারী গাড়ি ভাড়া করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অগত্যা তিনি গুরুর পরামর্শ না মেনে গণপরিবহনের টিকেট কেটে পঞ্চগড়ের পথে রওনা দেন। এটি ছিল চিত্রনাট্যের প্রথম বিচ্যুতি।
বিশিষ্ট কবি, দার্শনিক, মানবাধিকার কর্মী ও আত্মগুম বিশেষজ্ঞ ফরহাদ মজহার এ বিষয়ে বলেন, “দেখুন, এখানেই একজন নবীন শিল্পী আর একজন অভিজ্ঞ শিল্পীর পার্থক্য। মরিয়ম মান্নানের প্রযোজনায় কোনো কমতি ছিল না। তিনি তার মাকে নিখোঁজ করার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু মুফতি মিয়াজীর উদ্দেশ্য মরিয়ম মান্নানের চাইতে বৃহৎ হলেও কাজে আনাড়িপনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তিনি গণপরিবহনে চড়েছেন, পথের মাঝে হোটেলে নেমে নামাজ পড়েছেন। একজন অপহৃত ব্যক্তি কি যাত্রাবিরতিতে নামাজ পড়তে পারেন? এটা শিল্পের সঙ্গে ঘোরতর বেয়াদবি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “মরিয়ম মান্নানের নাটক ছিল একটি পারিবারিক বিবাদের ভিত্তিতে রচিত সামাজিক-অ্যাকশন ঘরানার। প্রতিবেশীদের ফাঁসানোই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মিয়াজী সাহেবের চিত্রনাট্য ছিল আরও ব্যাপক, আরও ভয়ঙ্কর! তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিলেন! তার গল্পে হিন্দু ধর্মীরা তাকে অপহরণ করে অকথ্য নির্যাতন করবে, দাড়ি কেটে দেবে, এমনকি বলাৎকারের মতো মর্মান্তিক অধ্যায়ও যুক্ত করা হয়েছিল, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সারাদেশে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে আক্রমণ চালানো। শুধু তাই নয়, তার এই নাটকের প্রচারণার অংশ হিসেবে ইসকনের মতো সংগঠনকে ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে দায়ী করা হচ্ছিল, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের সরকারপ্রধানকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছিল! বুঝুন একবার, শিল্পীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! তিনি শুধু তারকা হতে চাননি, চেয়েছিলেন দাঙ্গার নায়ক হতে। কিন্তু এত প্রতিভাবান নবীন একজন ‘শিল্পী’র কী করুণ পতন! তার সবচেয়ে বড় ভুল হলো গোপন ক্যামেরার শক্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করা। যে শিল্পীর চিত্রনাট্যে দেশব্যাপী দাঙ্গা বাধানোর মতো বিশাল ক্যানভাস থাকে, সে কিনা শ্যামলী পরিবহনের একটি টিকেট আর পথের ধারের হোটেলের গোপন ক্যামেরার কাছে ধরাশায়ী হয়ে যায়! এই যুগে এসেও যিনি গোপন ক্যামেরাকে ফাঁকি দিতে পারেন না, তিনি যত প্রতিভাবানই হোক না কেন, তাকে আমি শিল্পী বলতেই নারাজ।”
এদিকে, গাজীপুর মহানগরীর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আকস্মিক সংবাদ সম্মেলনে পুরো নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। তারা যখন সবিস্তারে মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর ভ্রমণকাহিনী বর্ণনা করছিলেন, তখন মিয়াজির অনুসারীরা এই ভেবে হতাশ হয়েছেন যে, একটি সম্ভাবনাময় নাটকের সমাপ্তি এভাবে কেন বলে দেওয়া হলো? নিজেদের মতো করে নাটকটা শেষ করার জন্য অনুসারীদের পর্যাপ্ত সময় কেন দেওয়া হলো না?
এই ঘটনায় চরম হতাশ হয়েছেন খুলনার কীর্তিমান কন্যা মরিয়ম মান্নান। তিনি তার স্ব-অপহরণ ও অন্তর্ধান কলাকেন্দ্র থেকে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “আমি খুবই ব্যথিত। আমার ছাত্র মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজী আমার মুখ রাখতে পারেনি। আমি তাকে শিখিয়েছিলাম কীভাবে ঝড় তুলতে হয়, কিন্তু সে মৃদু বাতাসও তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার অভিনয়ের দুর্বলতা এবং পরিকল্পনার অভাবে আমার প্রতিষ্ঠিত এই মহান শিল্প আজ প্রশ্নের মুখে। আমি তাকে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তবে এতকিছুর পরেও আশার আলো দেখছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণ-তরুণীরা মরিয়ম মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন স্ব-অপহরণ শিল্পে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। শোনা যাচ্ছে, খুব শীঘ্রই ‘বাংলাদেশ স্ব-অপহরণ একাডেমি’ একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, যেখানে ‘আত্মগোপন বিদ্যা’, ‘মিথ্যাচার কলা’ এবং ‘শিকল ও তালা ব্যবস্থাপনা’র মতো বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হবে। মুফতি মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর ব্যর্থতা হয়তো ভবিষ্যতের শত শত সফল স্ব-অপহরণ শিল্পীর জন্ম দেবে, এই আশাতেই বুক বেঁধেছে দেশের নাট্যপ্রেমী সমাজ।