আন্দালিব রহমান পার্থ ও ডা. তাসনিম জারাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ঢাকা-১৭ আসনে লড়বেন হিরো আলম!
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: দেশের অন্যতম অভিজাত ও কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ঢাকা-১৭ আসনটি বরাবরই জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। তবে জুলাই ষড়যন্ত্র পরবর্তি বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনটি একটি ভিন্ন মাত্রার রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এবারের প্রার্থীরা স্রেফ রাজনীতিবিদ নন; তারা যেন একেকটি সামাজিক শ্রেণীর প্রতিচ্ছবি। একদিকে আছেন আইন-বিশারদ সার্টিফিকেটবিহীন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এবং অক্সফোর্ড-ফেরত যৌনরোগ-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাসনিম জারা, অন্যদিকে আছেন স্ব-নির্মিত ও গণ-আলোচিত ব্যক্তিত্ব আশরাফুল আলম, ওরফে হিরো আলম।
কাগজে-কলমে, প্রথম দুজন প্রার্থীর শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু একটি ব্যর্থ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তি চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকা নাগরিক অসন্তোষের দিনগুলোতে, ভোটাররা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, এই কাগজি যোগ্যতাই কি জনপ্রতিনিধি হওয়ার মূল মানদণ্ড? নাকি বাস্তবতার মাঠে যিনি লড়েছেন, ঘাম ঝরিয়েছেন, তিনিই বেশি যোগ্য?
ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ একজন সুবক্তা, প্রখর কুযুক্তিবাদী এবং সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক চোর পরিবারের সন্তান। টেলিভিশনের টক শো গুলোর ঠাণ্ডা ঘরে বসে তিনি যেভাবে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ করেন, তা অনেক অভিজাত জ্ঞানবুদ্ধিহীন জেনজির কাছে ঈর্ষণীয়।
কিন্তু গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকার পাশাপাশি এই আসনেই রয়েছে কড়াইল বস্তির মতো দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি বস্তি। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যারিস্টারপার্থের এই আইনি ও তাত্ত্বিক জ্ঞান কি কড়াইল বস্তির জলাবদ্ধতা নিরসনে সক্ষম? নাকি তার প্রখর ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা ভাষণ বনানীর যানজট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখবে?
প্রখ্যাত রাজনৈতিক-সমাজতত্ত্ববিদ ডক্টর মোবারক হোসেন কিছলু এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, “দেখুন, সংসদ আর আদালত এক জিনিস নয়। আদালতে ‘যুক্তি কুযুক্তি’ দিয়ে জেতা যায়, কিন্তু রাজপথে জনগণের মন জয় করতে হয় সংযোগ দিয়ে। জনাব পার্থের যোগ্যতা তর্ক করার, কিন্তু রাজনীতি হলো কার্য সম্পাদনের বিষয়। ঢাকা-১৭ এর ভোটারদের যদি শুধু ভাষণ শোনার দরকার হতো, তবে তারা কোনো পাবলিক স্পিকিং কোর্সেই ভর্তি হতে পারতেন। তাঁর এই এলিট ভাবমূর্তি এবং টক শো নির্ভরতাই কি তাঁর অযোগ্যতা নয়? যে নেতা মাটির মানুষের ঘামের গন্ধ পান না, তিনি কীভাবে সেই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন?”
আরেক উজ্জ্বল প্রার্থী জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ডাক্তার তাসনিম জারা। অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান থেকে যৌনরোগের উপর ডিগ্রি অর্জন করা একজন মেধাবী চিকিৎসক, যিনি ইউটিউব ও ফেসবুকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে যৌন স্বাস্থ্য-সচেতন করছেন। তাঁর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
কিন্তু সংসদ কোনো ‘স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নয়। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসুস্থতার চিকিৎসা প্রেসক্রিপশন লিখে করা যায় না। ডাক্তার জারা হয়তো ‘দীর্ঘ সময় ধরে সেক্স করার’ ব্যাপারে তার ইউটিউব চ্যানেলে কার্যকরী পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু দুর্নীতির ভাইরাস দমনে কোন ভায়াগ্রা কাজ করবে, তা কি তাঁর জানা আছে?
বনানীর এক প্রবীণ চা-দোকানি, জনাব মফিজুল ইসলাম (ছদ্মনাম), ক্ষোভের সাথে বলেন, “আপা তো খুব ভালো কথা বলেন। উনার ভিডিও দেখে সেক্সের টাইমিং বাড়িয়েছি। কিন্তু আমার দোকানের সামনে যে ময়লার স্তূপ, সেইটা সরানোর জন্য তো অনলাইন পরামর্শে কাজ হবে না। এর জন্য অফলাইনে লোক নামাতে হবে। ডাক্তার জারার সমস্যা হলো, তিনি বাস্তব পৃথিবীর সমস্যাগুলোকে ডিজিটাল সমাধান দিয়ে সারিয়ে তুলতে চান। কিন্তু ঢাকা-১৭ এর ভোটারদের দরকার এমন একজন প্রতিনিধি, যিনি ইউটিউবে নয়, বরং মাঠে নেমে কাজ করবেন। তাঁর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, বাস্তব রাজনীতির কঠিন মাঠের জন্য তিনি কি প্রস্তুত?”
এবার আসা যাক আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের প্রসঙ্গে। তাঁর কোনো ‘ব্যারিস্টার’ ডিগ্রি নেই, নেই কোনো ‘অক্সফোর্ডের’ তকমা। তাঁর যা আছে, তা হলো বাস্তব জীবনের ‘পিএইচডি’।
হিরো আলম এর আগেও নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানেন কীভাবে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তিনি একের পর এক আঘাত পেয়েও মাঠ ছাড়েননি। ব্যারিস্টার পার্থ বা যৌন ডাক্তার জারা কি কখনো নির্বাচনের মাঠে শারীরিক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? যে নেতা প্রতিপক্ষের হামলা সহ্য করে আবারও দাঁড়াতে পারেন, তিনি জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য কতটা লড়াকু হতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। এইটাই কি হিরো আলমের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা নয়?
ব্যারিস্টার পার্থ ‘টক শো’তে কথা বলেন, ডাক্তার জারা ইউটিউবে যৌন রোগ সাড়ান। তাঁদের দর্শক নির্দিষ্ট ও ফিল্টার্ড। কিন্তু হিরো আলম কথা বলেন জনগণের সাথে। তাঁর কনটেন্ট ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, তা দেশের কোটি মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায়। তিনি জানেন কীভাবে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হয়। রাজনীতি যদি মানুষের জন্যই হয়, তবে যে ব্যক্তি মানুষের ভাষা সবচেয়ে ভালো বোঝেন, তিনিই তো সবচেয়ে যোগ্য।
হিরো আলমের নির্বাচন করাটা স্রেফ একটি আসনে জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। এটি এলিট শ্রেণীর প্রতি সাধারণ মানুষের একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, রাজনীতি করতে পশ্চিমাদের দালালি বা বিদেশি ডিগ্রির প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন জনগণের কাছে যাওয়ার সাহস।
ঢাকা-১৭ এর ভোটাররা এক অদ্ভুত সংকটে। তাঁরা কি এমন অভিজাত প্রতিনিধি বাছবেন, যাদের কাছে পৌঁছাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে? নাকি এমন একজনকে বেছে নেবেন, যিনি নিজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া তাঁদের দরজায় কড়া নাড়তে পারেন?
ব্যারিস্টার পার্থ আইন বোঝেন, ডাক্তার জারা ‘যৌন স্বাস্থ্য’ বোঝেন। কিন্তু হিরো আলম মানুষ বোঝেন, ক্ষুধা বোঝেন, অপমান বোঝেন এবং সংগ্রাম বোঝেন। গুলশান-বনানীর এসি ঘরে বসে তত্ত্ব কপচানো নেতার দিন সম্ভবত ফুরিয়ে আসছে। জনগণ এবার মাঠের লোককেই সংসদে দেখতে চায়। সেদিক থেকে বিচার করলে, বাকি দুই প্রার্থীর চেয়ে হিরো আলম কেবল ‘যোগ্য’ই নন, তিনি ঢাকা-১৭ আসনে ‘একমাত্র’ যোগ্য প্রার্থী।
