জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সাম্প্রতিক ভাইরাল বক্তব্য কি নিছক রাজনীতি নাকি মওদুদী ধর্মের নবজাগরণ?
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: মহাজাগতিক ইতিহাসের পাতায় এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না, যা গত কয়েক সপ্তাহে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া অঞ্চলে অবলোকন করছেন বিশ্ববাসী। বিজ্ঞানের সূত্রমতে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়, পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে দিন ও রাত হয়, এইসব পুরনো ও বাতিল থিওরিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন এক মহাজাগতিক সত্য উন্মোচন করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য শাহজাহান চৌধুরী। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তার জন্য সূর্য দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি সাধারণ কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং এটি একটি নতুন ধর্মতাত্ত্বিক বিপ্লবের ইঙ্গিত। পর্যবেক্ষক মহল এবং ধর্মতাত্ত্বিক গবেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে এতদিন নিছক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ছিল, তা ছিল একটি ভুল ধারণা। মূলত এটি একটি স্বতন্ত্র ধর্ম, যার নাম ‘মওদুদী ধর্ম’। এই ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীকে তারা সর্বশেষ নবী ও ত্রানকর্তা হিসেবে মান্য করে এবং তার নির্দেশিত পথেই পরিচালিত হয় এই ধর্মের অনুসারীরা। শাহজাহান চৌধুরী এই মওদুদী ধর্মের একজন উচ্চমার্গীয় নেতা ও প্রচারক, যার ইশারায় প্রশাসন ওঠাবসা করে এবং যার চোখের পানির ভয়ে মানুষের হাত-পা লুলা বা অবশ হয়ে যায়।
ঘটনার সূত্রপাত সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়নের তুলাতলী এলাকায় এক গণসংযোগকালে। সেখানে শাহজাহান চৌধুরী মওদুদী ধর্মের অলৌকিক মহিমা প্রচার করতে গিয়ে জানান, আল্লাহ তার জন্য সূর্যকে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এই বক্তব্য শুনে নাসার বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেছেন। তারা এতদিন জানতেন সূর্য একটি নক্ষত্র এবং পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু মওদুদী ধর্মের কসমোলজিতে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী বা সূর্য নয়, মহাবিশ্বের সবকিছুই মূলত শাহজাহান চৌধুরীর ইশারায় ঘুরছে অথবা থামছে। স্থানীয় মওদুদী ধর্মের অনুসারীদের মতে, শাহজাহান হুজুর যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন সূর্য মামা ভয়ে আর অস্ত যাওয়ার সাহস পান না। পাছে হুজুর চোখের পানি ফেলে দেন এবং সূর্য চিরতরের জন্য লুলা বা প্যারালাইজড হয়ে যায়, সেই ভয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ডিউটি পালন করতে থাকে। এই অলৌকিক ক্ষমতার উৎস হিসেবে তিনি তার ১৮ বছরের জেলজীবন, যা মূলত মওদুদী ধর্মের ‘চিল্লা’ বা সাধনার অংশ এবং মওদুদীর লেখা বইগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এই ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, মওদুদীর লেখা বইগুলো ঠিকমতো তিলাওয়াত করলে এবং তার রাজনৈতিক দর্শনকে ওহীর মতো মান্য করলে, একজন ভক্ত এমন স্তরে পৌঁছে যান যেখানে প্রকৃতির নিয়ম তার কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে।
শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, সেটি হলো ‘চুদুর বুদুর’ তত্ত্ব। মওদুদী ধর্মে ‘চুদুর বুদুর’ বা সমালোচনা করা এক অমার্জনীয় অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি কোনো পার্থিব আদালত বা বিচারক দেবেন না, বরং স্বয়ং শাহজাহান চৌধুরীর চোখের পানি এই বিচার করবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তিনি যদি চোখের পানি ফেলেন, তবে তার বিরোধীরা লুলা হয়ে যাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে পোলিও বা স্ট্রোকের কারণে মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় বলে জানা থাকলেও, মওদুদী ধর্মে ‘হুজুরের চোখের পানি’ হলো প্যারালাইসিসের মূল কারণ। এই হুমকির পর থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকার বাত-ব্যথার রোগীরাও ভয়ে সোজা হয়ে হাঁটছেন। মওদুদী ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, তাদের নেতার চোখের পানিতে এমন এক তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ রয়েছে, যা মাটিতে পড়ার আগেই বিরোধীদের স্নায়ুতন্ত্র বিকল করে দিতে সক্ষম।
কেউ যাতে উল্টাপাল্টা না বলে, সে ব্যাপারে শাহজাহান চৌধুরী কঠোর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। তার মতে, যারা তাকে চেনে না, তারা মাটির নিচে বসবাস করে। এই বক্তব্যের গূঢ় অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। তবে মওদুদী ধর্মের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যারা এই নতুন ধর্মের মাহাত্ম্য বোঝে না, তারা মূলত জিন্দা লাশ বা মাটির তলার বাসিন্দা, তাদের ওপরের আলো-বাতাস ভোগ করার কোনো অধিকার নেই।
প্রশাসন যন্ত্রকে নিজের আন্ডারে বা আয়ত্তে আনার বিষয়টিও শাহজাহান চৌধুরীর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার আরেকটি নিদর্শন। তিনি নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, প্রশাসনের লোকজনকে তাদের কথায় উঠতে হবে এবং বসতে হবে। তাদের কথায় গ্রেপ্তার করতে হবে এবং মামলা দিতে হবে। সাধারণ দৃষ্টিতে এটি আইনের শাসনের প্রতি হুমকি মনে হলেও, মওদুদী ধর্মের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ এই ধর্মে রাষ্ট্রযন্ত্র বা সংবিধানের চেয়ে মওদুদীর দর্শন এবং নির্দেশই চূড়ান্ত। ডিসি, এসপি বা ওসি, এরা সবাই মূলত মওদুদী ধর্মের সেবক বা খাদেম হিসেবে গণ্য হবেন। শাহজাহান চৌধুরীর মতো একজন কামেল নেতা যখন হুকুম দেবেন, তখন প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি ওঠাবসা না করেন, তবে তাদেরও ‘লুলা’ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। জানা গেছে, এই বক্তব্যের পর অনেক সরকারি কর্মকর্তা ভয়ে তাদের চেয়ারে বসছেন না, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকছেন, পাছে বসার টাইমিংয়ে হুজুরের হুকুমের বরখেলাপ হয়ে যায়। মওদুদী ধর্মে গণতন্ত্র বা নির্বাচনের চেয়ে ‘বাইয়াত’ বা আনুগত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জনগণ ভোট দেবে কি দেবে না, তা মুখ্য নয়; মুখ্য হলো প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঠিকমতো হুজুরের কথায় ব্যায়াম করছেন কি না।
শাহজাহান চৌধুরী আরও বলেছেন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আর কোনো মার্কা নেই, একটাই মার্কা দাঁড়িপাল্লা। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মূলত মওদুদী ধর্মের একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইসলাম ধর্মে যেমন শিরক বা অংশীদারিত্বের সুযোগ নেই, তেমনি মওদুদী ধর্মেও দাঁড়িপাল্লা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। তিনি এই অঞ্চলকে তার শায়খ বা ওস্তাদ মাওলানা মমিনুল হক চৌধুরীর জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করে মাটিকে সম্মান করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ, এই মাটি এখন আর বাংলাদেশের সাধারণ ভূখণ্ড নয়, এটি মওদুদী ধর্মের তীর্থস্থান বা পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে রাজনীতি নেই, আছে শুধু ইবাদত এবং সেই ইবাদতের ধরণ হলো দাঁড়িপাল্লায় সিল মারা এবং বিরোধীদের সাইজ করা। তার এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, জামায়াতে ইসলামী এখন আর কোনো রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো নিয়ে ভাবছে না। তারা এখন সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক লাইনে চলে গেছে। তাদের লক্ষ্য এখন সংসদ ভবন নয়, বরং আসমানি কিতাবের মতো মওদুদীর কিতাব দিয়ে দেশ শাসন করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শাহজাহান চৌধুরী অত্যন্ত জাঁদরেল ভঙ্গিতে বলছেন, “আমার নাম শাহজাহান চৌধুরী!” এই বাক্যটি তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন। মওদুদী ধর্মে নিজের নাম বারবার জপ করা এক ধরনের জিকির হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অথবা তিনি হয়তো নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে, সূর্য এবং প্রশাসন তার নাম ঠিকঠাক মনে রেখেছে কি না। কেননা নাম ভুলে গেলে যদি সূর্য হঠাৎ ডুবে যায় বা প্রশাসন যদি ভুল করে অন্য কারো কথায় উঠে দাঁড়ায়, তবে মহাজাগতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তার অনুসারীরা মনে করেন, শাহজাহান চৌধুরী এখন এমন এক মাকামে পৌঁছেছেন, যেখানে তার ইচ্ছাই আইন। তিনি চাইলে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারেন, যদিও আপাতত তিনি শুধু সূর্যকে থামিয়ে রাখার মধ্যেই তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তবে ভবিষ্যতে তিনি হয়তো চাঁদকেও ধমক দিয়ে বলবেন, “খবরদার, পূর্ণিমা হতে চুদুর বুদুর করিও না, লুলা হয়ে যাবে।”
পরিশেষে বলা যায়, শাহজাহান চৌধুরীর এই বক্তব্যগুলো নিছক কোনো রাজনৈতিক আস্ফালন নয়। এটি একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সংকেত। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে ধীরে ধীরে ‘মওদুদী রিলিজিয়ন’ বা একটি ভিন্ন ধর্মে রূপান্তর লাভ করেছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ এই বক্তব্য। ইসলাম ধর্মের বিনয় ও নম্রতার শিক্ষার সাথে এই হুমকি, ধমক এবং অলৌকিক দাবির কোনো মিল না থাকলেও, মওদুদী ধর্মের কিতাবে হয়তো এগুলোই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। শাহজাহান চৌধুরী সেই ধর্মেরই একজন ‘হাই প্রোফাইল’ ধর্মপ্রচারক, যিনি বিশ্বাস করেন মওদুদীর আশীর্বাদে এবং নিজের কারিশমায় তিনি প্রকৃতির নিয়ম এবং রাষ্ট্রের আইন—উভয়কেই নিজের পকেটে পুরে রাখতে সক্ষম। এখন দেখার বিষয়, সূর্য কতদিন তার ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং প্রশাসন কতদিন তার কথায় ওঠাবসা করে। তবে একটা কথা নিশ্চিত, যতদিন শাহজাহান চৌধুরীর চোখের পানি রিজার্ভে আছে, ততদিন সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার বাতাসে ‘লুলা’ আতংক বিরাজ করবেই।
#Cartunus Daily, #অলৌকিক ক্ষমতা, #আধ্যাত্মিক নেতা, #আবুল আ'লা মওদুদী, #আমি শাহজাহান চৌধুরী, #খবরদার, #চুদুর বুদুর, #চোখের পানি, #জামায়াতে ইসলামী, #দাঁড়িপাল্লা প্রতীক, #দৈনিক কার্টুনুস, #ধর্মীয় ব্যবসা, #প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, #ভাইরাল ভিডিও, #মওদুদি ধর্ম, #মওদুদী ধর্ম, #মওদুদী ধর্মের নবজাগরণ, #মওদুদী মতবাদ, #মওদুদীবাদী, #মৌদুদি ধর্ম, #লুলা হওয়ার অভিশাপ, #শাহজাহান চৌধুরী, #সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, #সাতকানিয়া লোহাগাড়া, #সূর্য আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, #সূর্য থামিয়ে দেওয়া