জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিওনা মন্তব্যে জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্ব

জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্ব: জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিওনা মন্তব্যে পরিবারে ভাঙন। A Family Divided: Jamaat-NCP Alliance Fractures Over 'Don't Challenge Your Father' Comment. জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্ব: জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিওনা মন্তব্যে পরিবারে ভাঙন। A Family Divided: Jamaat-NCP Alliance Fractures Over 'Don't Challenge Your Father' Comment.

নাহিদ ইসলাম বনাম গোলাম পরওয়ার: জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে।

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: রাজনীতির জটিল মাঠে আদর্শিক দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়, তবে সেই যুদ্ধ যখন ঘরের সম্মান আর বংশের গৌরব রক্ষার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তা সাধারণ মানুষের কাছে বিনোদনের এক অফুরন্ত উৎস হয়ে ওঠে। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমনই এক ‘পিতা-পুত্র’ কেন্দ্রিক পারিবারিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে। নবগঠিত পাকিস্তানপন্থী কিংস পার্টি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের দল জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব গোলাম পরওয়ার, যার প্রধান দুই কুশীলব। দুই প্রজন্মের এই দুই রাজাকার নেতার মধ্যেকার বাক্য-যুদ্ধ এখন শুধু রাজনৈতিক বারান্দায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দেশের চায়ের দোকান গুলোতেও আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক এবং জুলাই ষড়যন্ত্রের অন্যতম মুখ হিসেবে পরিচিত নেতা নাহিদ ইসলামের এক বিস্ফোরক ফেসবুক পোস্ট থেকে। সেখানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর অতি আলোচিত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা ‘পিআর’ পদ্ধতির আন্দোলনকে একটি ‘জঘন্য রাজনৈতিক প্রতারণা’ এবং ‘বৃদ্ধদের মস্তিষ্কপ্রসূত অপকৌশল’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও লেখেন, “যাঁরা যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না, কেবল রাজনীতির ধুলোমাখা বই আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন, তাঁরা নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা বুঝবেন কী করে? তাঁদের পিআর আন্দোলন আসলে রাষ্ট্র সংস্কারের মহৎ উদ্দেশ্যকে নর্দমায় নিক্ষেপ করে নিজেদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের একটি ঘৃণ্য পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

পুত্রের এমন তীক্ষ্ণ ও অপমানজনক বক্তব্যে পিতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে, তা ছিল দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। কিছুদিনের মধ্যেই সাতক্ষীরার এক ক্ষুদ্র ছাত্র-যুব সমাবেশে জামায়াতের অভিভাবকতুল্য মহাসচিব মিয়া গোলাম পরওয়ার পুত্রের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে স্নেহের চেয়ে শাসনের সুরই ছিল প্রকট। তিনি বলেন, “শুনলাম এক ছোকরা নেতা, যার বয়স আমার রাজনৈতিক বয়সের চেয়েও কম, আমাদের নিয়ে বড় বড় কথা বলছে। আরে বাবা, তোমরা তো সেদিনকার শিশু, এখনো তোমাদের মুখের দুধের গন্ধ যায়নি। রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে তোমাদের আরও কয়েক যুগ সাধনা করতে হবে। জন্ম নিয়েই বাপের সাথে পাল্লা দিওনা, কুস্তি লড়তে এসো না, শেষে মাটিতে এমন আছাড় খাবে যে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।”

তিনি এখানেই থামেননি। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “ওরা নাকি অভ্যুত্থানের নেতা! আরে, আমরা যখন রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিচ্ছিলাম, তখন তোমরা কোথায় ছিলে? বড়দের ছায়াতলে থেকে দু-একটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েই নিজেদের অভ্যুত্থানের জনক ভাবতে শুরু করেছ? আমরা তোমাদের মতো কাগুজে বাঘ নই। আমরা হলাম বনের আসল বাঘ। যাও, আগে ভালোভাবে লেখাপড়া করো, রাজনীতির অ-আ-ক-খ শেখো, তারপর আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসো।”

এই ‘পিতাঠাকুরের’ এমন বিধ্বংসী উপদেশবাণী যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির তরুণ তুর্কিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা পিতা মিয়া গোলাম পরওয়ারের মন্তব্যকে কেবল ‘রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য’ বলেই ক্ষান্ত হননি, বরং একে ‘বার্ধক্যজনিত মতিভ্রম’ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এক পাল্টা বিবৃতিতে বলেন, “রাজনীতির মাঠে কেউ কারো বাপ হতে চাইতে পারে না, এটা এক ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ততা। আমরা কোনো ব্যক্তি বা দলের সন্তান নই, আমরা গণ-অভ্যুত্থানের সন্তান। আর গণ-অভ্যুত্থানই আমাদের সকলের বাপ। যারা বিপদের সময় আমাদের নেতৃত্ব মেনে আন্দোলন করেছে, আজ বিপদমুক্ত হয়ে তারাই আমাদের ওপর পিতৃত্ব ফলাতে চাইছে! এটা রাজনৈতিক শঠতা এবং নির্লজ্জতার চূড়ান্ত উদাহরণ।”

পরিস্থিতি যখন ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছিল, তখন এই পারিবারিক বিবাদে হস্তক্ষেপ করেন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির, লুঙ্গির নিচের রাজনীতির জনক ডা. শফিকুর রহমান। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, “তরুণদের উদ্দীপনাকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু উদ্দীপনার সঙ্গে শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে তা ঔদ্ধত্যে পরিণত হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা আমাদের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। কিন্তু তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। আশা করি, তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলবে। জামায়াতে ইসলামী একটি বটবৃক্ষ, এর ছায়াতলে অনেকেই আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেই আশ্রয়কে দুর্বলতা ভাবাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।”

জামায়াত-এনসিপি দ্বন্দ্ব যখন রাজনৈতিক পরিবারটির ভাঙনকে প্রকট করে তুলেছে, ঠিক তখনই পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বিশ্ববরেণ্য সুদী মহাজন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানা গেছে, তিনি উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, “প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় এই ঘটনায় যারপরনাই ব্যথিত। তিনি মনে করেন, দেশ গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন তুচ্ছ পারিবারিক কলহ জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। তিনি উভয় পক্ষকে ডেকে একটি ঘরোয়া বৈঠকের মাধ্যমে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি তিনি রসিকতা করে বলেছেন, ‘দরকার হলে আমি নিজেই তোমাদের পারিবারিক কাউন্সিলর হতে রাজি আছি’।”

এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে দেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সোবহান আলী বলেন, “বিষয়টা এখন আর রাজনৈতিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ নেই, এটা একটা পুরোদস্তুর পারিবারিক নাটকে রূপ নিয়েছে। এখানে সম্পত্তি হলো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব। পুত্র মনে করছে, এই সম্পত্তির আসল মালিক সে। পিতা বলছেন, এই সম্পত্তি তাঁর পূর্বপুরুষদের আমল থেকে অর্জিত। অন্যদিকে, ড. ইউনূসের হস্তক্ষেপ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পারিবারিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমার পরামর্শ হলো, একটি সালিশি বৈঠক ডাকা হোক। সেখানে জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দলিল এবং এনসিপির পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের সময়কার কর্মকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করা হোক। তারপর নিরপেক্ষ বিচারকদের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে, কে ‘বাপ’ হওয়ার দাবিদার।”

আপাতত, পিতা-পুত্রের এই দ্বন্দ্ব কোন দিকে গড়ায়, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দেশের মানুষ। প্রধান উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় এই ভাঙা পরিবার আবার জোড়া লাগবে, নাকি ‘ত্যাজ্যপুত্র’ ঘোষণার মাধ্যমে এই নাটকের সমাপ্তি ঘটবে সেটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে কারণ যা-ই হোক, এই রাজনৈতিক পারিবারিক ধারাবাহিক যে জনগণকে বেশ কিছুদিন ভরপুর বিনোদন জোগাবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *