উদীচী ও ছায়ানটে হামলা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চোখে কালচারাল রেভোলিউশন

উদীচী ও ছায়ানটে হামলা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চোখে কালচারাল রেভোলিউশন। Attacks on Udichi and Chhayanaut: Cultural Revolution in the Eyes of Mostofa Sarwar Farooki. উদীচী ও ছায়ানটে হামলা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চোখে কালচারাল রেভোলিউশন। Attacks on Udichi and Chhayanaut: Cultural Revolution in the Eyes of Mostofa Sarwar Farooki.

উদীচী ও ছায়ানটে হামলা কি শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ নাকি এক নতুন ‘কালচারাল রেভোলিউশন’? মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর জবানবন্দিতে জানুন আগুনের লেলিহান শিখা ও ভাঙচুরের পেছনের ব্যাখ্যা।

মতামত, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: রাজধানীর তোপখানা রোডে যখন উদীচীর কার্যালয় দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন আমি আমার ড্রোন শটের মনিটরে দেখছিলাম এক অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি। আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর তার মাঝে কিছু এনার্জেটিক তরুণের দৌড়াদৌড়ি—দৃশ্যটা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আহা! এতোদিন আমরা স্টেজে বা অডিটরিয়ামে বসে কী সব বোরিং নাটক আর গানবাজনা করেছি! রিয়েল আর্ট তো হচ্ছে রাস্তায়, আগুনের লেন্স ফ্লেয়ারের ভেতর। উদীচী বা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন লাগা নিয়ে আপনারা যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কান্নাকাটি করছেন, তারা আসলে আর্ট বা সংস্কৃতির বিবর্তনটাই ধরতে পারছেন না। আপনারা এখনো সেই ১৯ সেঞ্চুরির রোমান্টিসিজমে আটকে আছেন, যেখানে হারমোনিয়াম বাজালেই সংস্কৃতি রক্ষা হয়। কিন্তু আমরা এখন ২৪-এ পা দিয়েছি, এখনকার সংস্কৃতি হতে হবে ফায়ার-বেসড, ডাইনামিক এবং এক্সপ্লোসিভ।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমি একটা ‘মেটাফোর’ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। এই যে ইনকিলাব মঞ্চের ভাই-ব্রাদাররা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর বদলা নিতে উদীচী আর ছায়ানটকে টার্গেট করেছে, এটাকে আপনারা বলছেন ‘তাণ্ডব’, আর আমি বলছি ‘কালচারাল ডিকনস্ট্রাকশন’। দেখেন, জ্যাক দেরিদা বলে গেছেন, কোনো কিছু নতুন করে গড়তে হলে আগে পুরনো স্ট্রাকচার ভাঙতে হয়। আমাদের ছেলেরা সেই ফিলোসফিটাই তো প্র্যাকটিস করছে! উদীচীর অফিসে আগুন দেওয়া মানে হলো পুরনো, জঞ্জালমগ্ন চিন্তাধারাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া, যাতে সেই ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন ‘ইনকিলাব’ কালচার জন্ম নিতে পারে। আপনারা দেখছেন ধ্বংস, আমি দেখছি স্পেস ক্রিয়েশন। এই যে হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরাগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে—এগুলো তো আসলে সিম্বল অফ ওপ্ৰেশন! এই বাদ্যযন্ত্রগুলো এতোদিন আমাদের কানে শুধুই সেক্যুলার সুর ঢুকিয়েছে, এখন সময় এসেছে সেই সুরের বদলে কাচ ভাঙার ঝনঝনানি আর আগুনের গর্জন শোনার। এটাই তো নিউ ওয়েভ মিউজিক!

অনেকে বলছেন, ছায়ানট তো রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্র, সেখানে হামলা কেন? আরে ভাই, রবীন্দ্রনাথ কি আজকের জেনারেশনের পালস বুঝতেন? তিনি কি জানতেন যে একদিন ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান দিয়ে গিটার ভাঙাটা একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াবে? ছায়ানটের অডিটরিয়ামে আগুন দেওয়াটা আসলে একটা ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’। আমরা কোটি টাকা খরচ করে স্টেজে লাইটিং করি, আর এখানে ন্যাচারাল ফায়ার দিয়ে ফ্রিতেই একটা ড্রামাটিক এম্বিয়েন্স তৈরি হয়ে গেলো। ইনকিলাব মঞ্চের ছেলেরা যখন ছায়ানটের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছিল, তখন তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ খেয়াল করেছেন? কী দুর্দান্ত রিদম! এক একটা বাড়ি দিচ্ছে আর কাচ ভাঙছে—এটাকে যদি আপনি পারকাশন আর্ট না বলেন, তবে আপনি শিল্পের কিছুই বোঝেন না। আমি তো ভাবছি, আগামীতে শিল্পকলা একাডেমিতে এই ভাঙচুরকারীদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করাবো, যার নাম হবে ‘স্ট্রাইক হার্ড: দ্য আর্ট অফ ভ্যান্ডালিজম’।

শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই যে আবেগ, এই যে ক্ষোভ—এটাকে আমি স্যালুট জানাই। একজন অ্যাক্টিভিস্ট মারা গেছেন, তার শোক তো পালন করতে হবেই। আর শোক পালনের সেরা উপায় কী? মোমবাতি জ্বালানো? উঁহু, ওসব এখন ব্যাকডেটেড। এখন শোক পালন করতে হয় অন্যের ঘর জ্বালিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে শোক পালন করাটা অনেক বেশি সিনেমাটিক। এটা ভিজ্যুয়ালি অনেক স্ট্রং। উদীচীর লাইব্রেরি যখন পুড়ছিল, তখন আমি ভাবছিলাম, এই যে বইগুলো পুড়ছে, এর ধোঁয়াটা আসলে জ্ঞানের নতুন ডাইমেনশন। বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করার দিন শেষ, এখন বই পোড়ানোর আগুনের তাপে মস্তিষ্ক গরম করাই হলো আসল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। যারা বলছে সরকার ব্যর্থ, তারা আসলে সরকারের ভিশনটাই বুঝতে পারছে না। সরকার তো ব্যর্থ হয়নি, সরকার বরং এই ‘ফায়ার ফেস্টিভ্যাল’ সফলভাবে আয়োজন করার সুযোগ করে দিয়েছে। পুলিশ বা আর্মি যে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং আগুন নেভাতে দেরি করেছে, সেটাও স্ক্রিপ্টের অংশ। সাসপেন্স না থাকলে কি ক্লাইম্যাক্স জমে?

প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার অফিসে হামলার ব্যাপারটা নিয়েও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করছেন। বলছেন, মিডিয়ার ওপর হামলা মানে বাকস্বাধীনতায় আঘাত। আরে ভাই, আপনারা এত সিরিয়াস কেন? মিডিয়া তো নিউজ করে, আর আমাদের ছেলেরা নিউজ ‘তৈরি’ করে। ডেইলি স্টারের কাচ ভাঙার দৃশ্যটা দেখেছেন? কী সুন্দর সিমেট্রি! মনে হচ্ছিল ক্রিস্টাল প্যালেস ভেঙে পড়ছে। এটা তো মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হওয়ার মতো দৃশ্য। আর সম্পাদক নূরুল কবীরকে যে হেনস্তা করা হলো, সেটাকে আমি বলবো ‘ইন্টার‍্যাক্টিভ থিয়েটার’। এতোদিন তিনি এসি রুমে বসে সম্পাদকীয় লিখতেন, আর এখন রাস্তায় নেমে পাবলিকের সাথে সরাসরি ফেস-টু-ফেস ডায়ালগ করছেন—এটা তো তার সাংবাদিকতা জীবনের এক নতুন অ্যাচিভমেন্ট! আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এই ধরনের ‘স্ট্রিট জার্নালিজম’ কে প্রমোট করতে চাই। সাংবাদিকরা শুধু লিখবে না, মাঝে মাঝে মারও খাবে, দৌড়ানি খাবে—তবেই না নিউজে রিয়েলিস্টিক টাচ আসবে!

আমাদের সংস্কৃতিতে একটা বড় সমস্যা হলো, আমরা বড্ড বেশি সফট। গান গাই, কবিতা আবৃত্তি করি, ছবি আঁকি। কিন্তু এই সফটনেস দিয়ে কি আর বিশ্বজয় করা যায়? তাই আমি এবং আমার মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে ‘হার্ড কালচার’ প্রমোট করবো। বাউলদের চুল কেটে দেওয়া, মাজারে হামলা করা, উদীচী পোড়ানো—এগুলো সবই সেই হার্ড কালচারের অংশ। আপনারা বলছেন মৌলবাদ, আমি বলছি ‘র‍্যাডিক্যাল আর্ট মুভমেন্ট’। ইনকিলাব মঞ্চের ছেলেরা যা করছে, তা আসলে ইউরোপের রেনেসাঁসের মতো। তারাও তো চার্চের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক কিছু ভেঙেছিল, তাই না? আমাদের ছেলেরা এখন মূর্তির বিরুদ্ধে, গানের বিরুদ্ধে, ছবির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। এই জেহাদ তো শিল্পেরই এক নতুন ফর্ম। আপনারা তাদের হাতে লাঠি দেখছেন, আমি দেখছি তুলি। তারা যখন লাঠি দিয়ে কারো মাথায় বাড়ি মারে, তখন আসলে তারা সমাজের ক্যানভাসে এক নতুন রঙের ছোপ দেয়—লাল রঙের ছোপ। ব্লাড রেড! এর চেয়ে নান্দনিক আর কী হতে পারে?

বামপন্থী সংগঠন হিসেবে উদীচীর একটা ঐতিহাসিক ভাবমূর্তি আছে, আমি সেটা ডিনাই করছি না। কিন্তু ইতিহাস তো মিউজিয়ামে রাখার জিনিস। জীবন্ত সমাজে ইতিহাসকে রি-রাইট করতে হয়। আর রি-রাইট করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা। আমাদের এই ইরেজার হলো আগুন। উদীচীর আর্কাইভ পুড়ে গেছে বলে যারা হাহাকার করছেন, তাদের বলি—ভাই, ডিজিটাল যুগে কাগজের আর্কাইভ দিয়ে কী হবে? সব কিছু ক্লাউডে তুলে রাখেন। আর যদি ক্লাউডে না থাকে, তাহলে বুঝে নেন ওগুলোর দরকারই ছিল না। ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরি অনুযায়ী, যা আগুনে পুড়ে যায়, তা দুর্বল; আর যা আগুন সহ্য করে টিকে থাকে, সেটাই আসল সত্য। এখন থেকে আমাদের সত্য হলো এই ছাই। আমরা এই ছাই দিয়ে নতুন বাংলাদেশের তিলক কাটবো।

আমি জানি, আমার এই কথাগুলো শুনে সুশীল সমাজের অনেকেই ‘শকড’ হবেন। বলবেন, ফারুকী পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি পাগল হইনি, আমি জাস্ট একটু বেশি ভিশনারি হয়ে গেছি। আমি দেখতে পাচ্ছি, আগামী দিনের বাংলাদেশে আর কোনো হারমোনিয়াম থাকবে না, থাকবে শুধু সাইরেন। দোতারার তারের বদলে থাকবে কাঁটাতার। আর গানের আসরের বদলে বসবে জিকিরের হাল্কা, সাথে একটু আগুনের পরশমণি। এই যে ট্রান্সফরমেশন, এটা কি এক্সাইটিং না? আপনারা শুধু নেগেটিভ সাইডটা দেখছেন। একটু পজিটিভলি ভাবুন। উদীচী পোড়ার ফলে তোপখানা রোডের মশা কমে গেছে, বাতাসের আর্দ্রতা কমেছে—এগুলো কি লাভ না? আর ছায়ানটের ভাঙা কাচগুলো রিসাইকেল করে আমরা নতুন কোনো ভাস্কর্য বানাতে পারি, যার নাম দিবো ‘দ্য ব্রোকেন মেলোডি’।

সবশেষে বলি, ভয় পাবেন না। এনজয় দ্য শো। এই যে চারদিকে আগুন, ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া—এগুলো হলো আমাদের কালচারাল রেভোলিউশনের একেকটা এপিসোড। নেটফ্লিক্সের সিরিজ দেখার চেয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে নিজের শহরটাকে দেখুন। কী দুর্দান্ত অ্যাকশন! কী সাসপেন্স! কে কখন মারা যাবে, কার বাড়ি কখন পুড়বে—এই অনিশ্চয়তাই তো জীবনকে থ্রিলিং করে তোলে। আমরা চাই না আমাদের নাগরিকরা বোরিং লাইফ লিড করুক। আমরা তাদের জীবনে এড্রেনালিন রাশ দিতে চাই। তাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইনকিলাব মঞ্চ এবং অন্যান্য ‘পারফর্মিং আর্টিস্ট’দের আমি অভিনন্দন জানাই। আপনারা চালিয়ে যান। ভাঙুন, পোড়ান, গুঁড়িয়ে দিন। কারণ, যা কিছু সুন্দর, তা ধ্বংসপ্রবণ। আর যা কিছু ধ্বংসাত্মক, তাই তো আজকের বাংলাদেশে একমাত্র সত্য। আসুন, আমরা সবাই মিলে ছাইয়ের গাদায় বসে সমস্বরে গান ধরি—‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *