ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকার: জীবন বাঁচাতে জেনে নিন পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: ডেঙ্গু জ্বর বর্তমান সময়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে এবং এর পরবর্তী সময়ে এর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এডিস মশাবাহিত এই রোগটি সঠিক সময়ে শনাক্ত না হলে এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই, সঠিক সচেতনতা এবং পরিচ্ছন্নতাই পারে আমাদেরকে এবং আমাদের পরিবারকে ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষিত রাখতে।
এই প্রতিবেদনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়, মশা নিধন, লক্ষণ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
শত্রু চিনুন (এডিস মশা ও তার স্বভাব)
ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় মূলত দুই ধরণের মশার মাধ্যমে, এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস (Aedes albopictus)। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগে এই মশার স্বভাব সম্পর্কে জানা জরুরি: ১. প্রজনন স্থল: এডিস মশা কখনোই নোংরা বা ড্রেনের পানিতে ডিম পাড়ে না। এরা স্বচ্ছ বা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়তে পছন্দ করে। ২. কামড়ানোর সময়: এরা সাধারণত দিনের বেলা, বিশেষ করে খুব সকালে সূর্যোদয়ের পর এবং বিকেলে সূর্যাস্তের আগে কামড়ায়। তবে রাতে উজ্জ্বল আলোতেও এরা কামড়াতে পারে। ৩. উড়বার ক্ষমতা: এডিস মশা মাটি থেকে খুব উঁচুতে উড়তে পারে না, তাই পায়ের দিকেই এরা বেশি কামড়ায়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের করণীয় (প্রতিরোধই সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা)
ডেঙ্গু থেকে বাঁচার একমাত্র এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা এবং নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করা।
ক) মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা (সোর্স রিডাকশন): এডিস মশা জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। তাই আমাদের প্রধান কাজ হলো পানি জমতে না দেওয়া।
-
বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনা: ছাদ বাগান বা বারান্দার টবে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন। টবের নিচে থাকা প্লেটে ৩ দিনের বেশি পানি জমতে দেবেন না।
-
পরিত্যক্ত পাত্র: ডাব বা নারিকেলের খোসা, ভাঙা হাড়ি-পাতিল, পুরোনো টায়ার, চিপসের প্যাকেট বা আইসক্রিমের কাপ যেখানে বৃষ্টির পানি জমতে পারে, সেগুলো দ্রুত অপসারণ করুন।
-
ফ্রিজ ও এসি: ফ্রিজের পেছনের ট্রে এবং এসির পানি পড়ার স্থানে অনেক সময় পানি জমে থাকে, যা আমরা খেয়াল করি না। এগুলো প্রতি ৩ দিন পর পর পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে ব্লিচিং পাউডার বা লবণ ছিটিয়ে দিন।
-
বাথরুম ও রান্নাঘর: বাথরুমের বালতি বা ড্রামে পানি ৫ দিনের বেশি জমিয়ে রাখবেন না। কমোডের ঢাকনা বন্ধ রাখুন এবং অব্যবহৃত কমোড নিয়মিত ফ্লাশ করুন।
-
নির্মাণাধীন ভবন: আপনার এলাকার নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্তে বা কিউরিং করার জন্য জমিয়ে রাখা পানিতে মশা জন্ম নিচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখুন। প্রয়োজনে পোড়া মবিল বা কেরোসিন ঢেলে দিন।
খ) নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করা:
-
পোশাক: দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ঢাকা থাকে এমন পোশাক পরিধান করুন। ফুল হাতা শার্ট, টি-শার্ট এবং ট্রাউজার পরা ভালো। শিশুদের হাফ প্যান্ট পরানো থেকে বিরত থাকুন।
-
মশারির ব্যবহার: দিনে ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করার অভ্যাস করুন। এটি সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
-
রিপেলেন্ট ব্যবহার: মশা তাড়ানোর জন্য শরীরে ব্যবহারযোগ্য ওডোমস বা মসকুইটো রিপেলেন্ট ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে পারেন। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
-
জানালা ও দরজা: সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় মশার উপদ্রব বাড়ে, তাই এ সময় ঘরের জানালা ও দরজা বন্ধ রাখা উচিত। জানালায় মশা নিরোধক নেট লাগানো একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
পর্ব-৩: ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ (কখন বুঝবেন আপনি আক্রান্ত?)
সাধারণ ভাইরাল জ্বর এবং ডেঙ্গু জ্বরের মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। এডিস মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়।
-
তীব্র জ্বর: হঠাৎ করে ১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর আসা।
-
ব্যথা: প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা (Retro-orbital pain), এবং শরীরের হাড় ও গিরায় তীব্র ব্যথা (এজন্য একে ‘ব্রেক বোন ফিভার’ বলা হয়)।
-
র্যাশ বা দানা: জ্বরের ৩-৪ দিন পর শরীরে লালচে দানা বা র্যাশ দেখা দিতে পারে।
-
বমি ও অরুচি: বমি বমি ভাব, খাবারে তীব্র অরুচি এবং পেটে অস্বস্তি হওয়া।
সতর্কতা বা ওয়ার্নিং সাইন (বিপজ্জনক লক্ষণ): যদি জ্বরের সাথে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে কালক্ষেপণ না করে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে: ১. প্রচণ্ড পেট ব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া। ২. দাঁতের মাড়ি, নাক বা বমির সাথে রক্তক্ষরণ। ৩. শ্বাসকষ্ট বা পেট ফুলে যাওয়া (পেটে পানি আসা)। ৪. শরীর খুব বেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া বা নিস্তেজ হয়ে পড়া। ৫. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া।
আরো পড়ুন: ভূমিকম্পের সময় ও আগে-পরে করণীয়: জীবন রক্ষাকারী সম্পূর্ণ নির্দেশিকা
পর্ব-৪: ডেঙ্গু হলে করণীয় এবং চিকিৎসা
ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই। এর চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক এবং সাপোর্টিভ।
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম: ডেঙ্গু রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম একদম নিষেধ। ২. তরল খাবার: এটিই চিকিৎসার মূল চাবিকাঠি। রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়াতে হবে। যেমন, খাবার স্যালাইন (ORS), ডাবের পানি, ফলের জুস, স্যুপ এবং সাধারণ পানি। শরীরের জলীয় অংশ কমে যেতে দেওয়া যাবে না। ৩. জ্বরের ওষুধ: জ্বরের জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করুন। ৪. নিষিদ্ধ ওষুধ: কোনোভাবেই অ্যাসপিরিন (Aspirin), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) বা অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৫. অ্যান্টিবায়োটিক নয়: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না, কারণ ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এখানে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না।
পর্ব-৫: প্লাটিলেট নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না
ডেঙ্গু হলেই মানুষের প্রথম চিন্তা থাকে ‘প্লাটিলেট’ বা রক্তকণিকা নিয়ে। মনে রাখবেন, প্লাটিলেট কমে যাওয়া মানেই রক্ত দিতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে দেড় থেকে চার লাখ প্লাটিলেট থাকে। ডেঙ্গুতে এটি কমে বিশ হাজার বা দশ হাজারের নিচে নামলে এবং সাথে রক্তক্ষরণ থাকলে তখনই কেবল প্লাটিলেট বা রক্তের প্রয়োজন হয়। প্লাটিলেটের চেয়ে বেশি জরুরি হলো রোগীর রক্তচাপ (Blood Pressure) এবং হেমাটোক্রিট (Hematocrit) ঠিক আছে কি না তা দেখা। তাই অযথা আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
পর্ব-৫: কখন হাসপাতালে যাবেন?
ডেঙ্গু আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ) ডাক্তারের পরামর্শ মেনে বাসায় বিশ্রাম ও তরল খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে ডেঙ্গু জ্বরের ৫ম বা ৬ষ্ঠ দিনটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, একে বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’। জ্বর কমে যাওয়ার পরপরই মূলত জটিলতাগুলো শুরু হতে পারে।
নিচের যেকোনো একটি লক্ষণ (Warning Signs) দেখা মাত্রই রোগীকে আর বাসায় রাখা যাবে না, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে:
১. তীব্র পেট ব্যথা: যদি রোগীর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং পেটে হাত দিলেই ব্যথা অনুভব করে।
২. ক্রমাগত বমি: যদি ২৪ ঘণ্টায় ৩ বারের বেশি বমি হয় অথবা রোগী কোনো কিছুই পেটে রাখতে না পারে এবং অনবরত বমি করতে থাকে।
৩. রক্তক্ষরণ: শরীরের যেকোনো অংশ দিয়ে রক্তপাত হলে। যেমন: দাঁতের মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া। বমির সাথে রক্ত যাওয়া বা কফ এর সাথে রক্ত আসা। পায়খানা কালো হওয়া (এটি পেটের ভেতর রক্তক্ষরণের লক্ষণ)। মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া।
৪. শ্বাসকষ্ট: পেটে বা ফুসফুসে পানি জমার কারণে যদি রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা বুক ভারী লাগে।
৫. চরম দুর্বলতা বা নিস্তেজ ভাব: রোগী যদি অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সারাক্ষণ ঝিমুনি ভাব থাকে অথবা অস্থিরতা (Restlessness) অনুভব করে।
৬. শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া: যদি হঠাৎ করে শরীর অস্বাভাবিক ঘামতে থাকে এবং হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় (এটি শক সিনড্রোম বা রক্তচাপ কমে যাওয়ার লক্ষণ)।
৭. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া: যদি গত ৬ ঘণ্টায় রোগী একবারও প্রস্রাব না করে অথবা প্রস্রাবের পরিমাণ খুব কমে যায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য (ঝুঁকিপূর্ণ রোগী): লক্ষণ যাই হোক না কেন, নিচের ক্যাটাগরির রোগীদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে শুরু থেকেই হাসপাতালে বা ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত:
-
১ বছরের কম বয়সী শিশু।
-
বয়স্ক ব্যক্তি (৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে)।
-
গর্ভবতী মা।
-
যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, কিডনি বা লিভারের রোগ আছে।
-
যারা একা থাকেন বা যাদের সেবা করার মতো কেউ নেই।
মনে রাখবেন, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার চেয়ে রক্তচাপ (Blood Pressure) কমে যাওয়া এবং হেমাটোক্রিট (Hematocrit) বেড়ে যাওয়া অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাই এই ওয়ার্নিং সাইনগুলো দেখা দিলে এক মুহূর্তও দেরি করবেন না।
উপসংহার
ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। ‘আমার বাড়িতে মশা নেই’ এই আত্মবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজের বাড়ি এবং আশপাশ পরিষ্কার করুন। মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতাই আপনার পরিবারের সুরক্ষা। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা বা অবৈধ ইউনূস সরকারের ওপর ভরসা না করে, পাড়া-মহল্লায় সামাজিকভাবে মশা নিধন অভিযান গড়ে তুলুন। সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।