প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক, সেটাই যেন এনসিপি নেতাদের জন্য নয়া বন্দোবস্ত; গতবারের ‘সাফল্যের’ পর নতুন বন্যার খবরে আবারও ত্রাণ সংগ্রহের প্রস্তুতি, লক্ষ্য এবার আরও বড় তহবিল, আরও বিলাসবহুল গাড়ি।
নিজস্ব কার্টুনুস প্রতিবেদক: আকাশে মেঘ দেখলে বা বন্যার পূর্বাভাসে যেখানে সাধারণ মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, সেখানে একদল মানুষের মনে আনন্দের লহর বয়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই মাসের শেষ দিকে টানা বর্ষণে ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে আবারও বন্যার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই সংবাদ টিভিতে প্রচার হওয়ামাত্রই রাজধানীর বুকে সদ্য গজিয়ে ওঠা পাকিস্তানপন্থী নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)-র সদর দপ্তরে যেন আনন্দের ঈদ নেমে এসেছে। দলের নেতারা একে অপরকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন, পুরোনো দানবাক্সগুলো ঝেড়ে মুছে প্রস্তুত করছেন এবং কেউ কেউ গ্যারেজে রাখা গত বছরের ‘ত্রাণ তহবিল’ দিয়ে কেনা চকচকে গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন— ‘আহা পুরো একটা বছর অপেক্ষা করা লাগলো, এবার তোদের নয়া সঙ্গী আসবে!’
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের বন্যা ব্যবসায় উত্থান অবশ্য বেশ নাটকীয়। দেশবাসী ভুলে যায়নি, গত ২০২৪ সালের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই নেতারাই মানুষের আবেগকে পুঁজি করে এক মহাকাব্যিক ত্রাণ সংগ্রহের আয়োজন করেছিলেন। তাঁদের মায়াকান্নায় গলে গিয়ে দেশের মানুষ উজাড় করে দিয়েছিল নিজেদের সঞ্চয়। ফলস্বরূপ, মাত্র ১৩ দিনে সংগৃহীত হয়েছিল নগদ, মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক মিলিয়ে সর্বমোট ১১ কোটি ১০ লাখ ১৩ হাজার ৫৬৯ টাকা! এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের পর দেশবাসী যখন ভাবছিল, এবার বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃখ ঘুচল বলে, ঠিক তখনই ঘটল আসল টুইস্ট। বন্যার পানি নামার সাথে সাথে নেতারাও যেন উধাও হয়ে গেলেন। ত্রাণের বদলে আলোচনায় এল নেতাদের নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি ও বিলাসবহুল জীবনযাপন।
‘বন্যা ব্যবসা আন্দোলনের’ পুরোধা এবং বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির ভাঁড়প্রাপ্ত আমীর আল্লামা হাসনাত ‘গাড়িওয়ালা’ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে দলটি এখন নয়া বন্যার স্বপ্নে বিভোর। বুধবার বিকালে পার্টির কার্যালয়ে এক জরুরি ‘বন্যা প্রস্তুতি’ সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি। সভায় তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “ভাইসব আমার, গত বছর আমরা জাতির ক্রান্তিলগ্নে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা ১১ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছিলাম। এই বিপুল অর্থ বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানো কি মুখের কথা? এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা এবং… এবং একটি সুরক্ষিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।”
এ কথা বলতেই তিনি হু হু করে কেঁদে ফেলেন। রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “আপনারা জানেন, সেই টাকা কত নিরাপদে আছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, একজন নারী শিক্ষার্থী এবং আমার মতো একজন ছাত্র— এই তিনজনের যৌথ স্বাক্ষরে খোলা অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো সযত্নে রাখা আছে। এই তিনজনের একজনও যদি বেঁকে বসে, টাকা তোলা অসম্ভব। আর আপনারা তো জানেনই, আমি কতটা নীতিবান। বাকি দুজনের কথা না-ই বা বললাম। তারা আমার চেয়েও নীতিবান। তাই টাকাগুলো আজও তোলা হয়নি। বন্যার্তদের জন্য রাখা টাকা কি আমরা এমনি এমনি খরচ করতে পারি? পারি না!”
তাঁর এই বক্তব্য শেষ হতেই করতালিতে ফেটে পড়ে সভার সকলে। পার্টির কোষাধ্যক্ষ ও ‘বন্যা মানেই আমি বড়লোক’ প্রকল্পের সিইও, জনাব ‘কালেকশন’ কাওসার দাঁড়িয়ে বলেন, “আমীর সাহেব একদম খাঁটি কথা বলেছেন। টাকা ব্যাংকে নিরাপদে আছে। তবে আমরা তো আর বসে নেই। সেই টাকার উপর যেন কোনো খারাপ নজর না পড়ে, তাই আমরা গত বছর কয়েকটি ‘ত্রাণ পর্যবেক্ষণকারী যান’ ক্রয় করেছিলাম। আপনারা যেগুলোকে ল্যান্ড ক্রুজার বা প্রাডো বলেন, সেগুলো আসলে আমাদের ‘অল-টেরেইন রেসকিউ ভেহিকল’। আমরা সেই গাড়িগুলো নিয়ে দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এসেছি যে, কোথায় কোথায় ত্রাণ দেওয়া যেত। পর্যবেক্ষণ করতে করতেই তো এক বছর কেটে গেল!”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখন নতুন বন্যার পূর্বাভাস এসেছে। এটা আমাদের জন্য একটা নতুন সুযোগ। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আমরা আরও বেশি কার্যকরভাবে ‘পর্যবেক্ষণ’ করতে পারব। এবার আমাদের লক্ষ্য দ্বিগুণ। গতবার ১১ কোটি উঠেছিল, এবার আমাদের টার্গেট ২২ কোটি। দেশের মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের পকেট খালি করে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর এই মহৎ সুযোগ আমরা হারাতে পারি না।”
এদিকে খবর পাওয়া গেছে, বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই দলের নেতারা বিভিন্ন শপিং মলে ঢুঁ মারছেন। কেউ দেখছেন নতুন মডেলের রেইনকোট, কেউ কিনছেন গামবুট, আবার কেউ কেউ গাড়ির শো-রুমে গিয়ে নতুন মডেলের এসইউভি দেখছেন এবং সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করছেন, “এইটা কি কাদা-পানিতে ভালো চলবে? মানে, ত্রাণ বিতরণের জন্য আরকি!”
দলের তরুণ নেতা এবং ‘আবেগঘন ফেসবুক পোস্ট বিশেষজ্ঞ’ জনাব সারজিস ‘জমিদারের নাতি’ আলম জানিয়েছেন, তাঁরা এবার ডিজিটাল প্রচারণায় বেশি জোর দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “গতবার আমরা শুধু কান্নাকাটি করে টাকা তুলেছি। এবার কান্নার সাথে থাকবে প্রযুক্তির ছোঁয়া। আমরা থ্রিডি অ্যানিমেটেড কান্নার ভিডিও বানাব। ড্রোন উড়িয়ে বন্যার্তদের হাহাকারের ফুটেজ লাইভ স্ট্রিম করব। আমাদের কান্নার ইমপ্যাক্ট যাতে আরও দশগুণ বেড়ে যায়, তার জন্য যা যা করা দরকার, সব করব। আমাদের লক্ষ্য, প্রত্যেক নাগরিকের ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে আনা”
গত বছরের সেই ১১ কোটি টাকার কী হলো, এই প্রশ্নের উত্তরে নেতারা বরাবরই স্বচ্ছতার কথা বলেন। আল্লামা হাসনাত ‘গাড়িওয়ালা’ আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা একটি অডিট করছি। একটি আন্তর্জাতিক মানের অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ। তবে বুঝতেই তো পারছেন, ১১ কোটি টাকার হিসাব, এটা তো চাট্টিখানি কথা নয়। একটু সময় তো লাগবেই। ততদিন পর্যন্ত আপনারা ধৈর্য ধরুন এবং নতুন বন্যার জন্য প্রস্তুতি নিন। পকেট গরম রাখুন, কারণ আমরা আসছি!”
এদিকে, গত বছরের বন্যায় ঘর হারানো ফেনির ছাগলনাইয়া এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার মিয়া দূর থেকে এই খবর শুনে একগাল হেসে বলেন, “বাবারা গতবারও আইছিল। টিভিতে খুব কান্দন দেখাইছিল। হেরা নাকি আমাগো লাইগা কত কোটি টেকা তুলছে। হেই টেকার একখান নোটও চোখে দেখলাম না। তয় কাইলকা টিভিতে দেখলাম, যে পোলাডা বেশি কানছিল, হে একটা কালা রঙের চকচকা জিপ গাড়িতে কইরা কই জানি যায়। মনে হয়, এইবারও আমাগো লাইগা কানতে আইব। আল্লায় হেগোরে আরও বড় গাড়ি দেওনের তৌফিক দেক।”
নতুন বন্যার আশঙ্কায় যখন সত্যিকারের দুর্গত মানুষেরা আতঙ্কিত, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টির অফিসে চলছে উৎসবের আমেজ। নেতারা নতুন করে দানবাক্স ডিজাইন করছেন, টি-শার্ট ছাপানোর অর্ডার দিচ্ছেন এবং কে কত আবেগ দিয়ে কাঁদতে পারবেন, তার মহড়া দিচ্ছেন। তাঁদের রক্তে এখন কোটি টাকা চুরির উন্মাদনা। বন্যা আসুক বা না আসুক, তাঁদের ‘ত্রাণ সংগ্রহের মহোৎসব-২০২৫’ যে আসছে, তা নিশ্চিত। আর সেই উৎসবের উদ্বোধনী দিনে হয়তো আমরা দেখতে পাব, আল্লামা হাসনাত ‘গাড়িওয়ালা’ আব্দুল্লাহ একটি নতুন মডেলের ‘ত্রাণবাহী’ লেক্সাস থেকে নেমে ফিতা কেটে বলছেন, “আসুন, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই!”
আপনার মতামত জানান