চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি কোম্পানি দায়িত্ব নেওয়ায় মাশুল বৃদ্ধির আশঙ্কা: দেশি সক্ষমতা থাকার পরও কেন বিদেশিদের হাতে চাবি তুলে দেওয়া হচ্ছে?
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: জাতি হিসেবে আমরা আমাদের অক্ষমতাকে স্বীকার করে নেওয়ার মতো বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি। হাজার বছরের লড়াকু বাঙালি জাতি যে আসলে বন্দর চালানোর মতো সাধারন কাজটি করা যোগ্যতাও রাখে না, তা আবারও প্রমাণ করলেন ড. ইউনূসের বর্তমান ‘সংস্কার-সরকার’। চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া এবং ঢাকার অদূরে পানগাঁও বন্দরকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে যে ‘বৈপ্লবিক সংস্কার’ সাধিত হলো, তা দেখে দেশের সাধারণ জনগণ আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের পানি এবং পকেটের টাকা, দুটোই ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ড.ইউনূস বীরদর্পে জানান দিচ্ছেন। তার সংস্কারের মূলমন্ত্রই হলো, যা নিজেরা পারি না, বা পারলেও করতে ইচ্ছা করে না, তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া। একেই বলে ‘গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড’ বা বিশ্বমানের চিন্তাভাবনা। দেশি মানুষ দিয়ে বন্দর চালালে সেখানে কেবল ধুলোবালি আর জ্যাম থাকে, কিন্তু ডেনমার্ক বা সুইজারল্যান্ড থেকে লোক এসে যখন একই ধুলোবালি ওড়াবে, তখন তাকে বলা হবে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডাস্ট’ বা আন্তর্জাতিক ধুলা। এই ধুলা নাকে গেলে হাঁচিতেও আসবে ফ্রেঞ্চ পারফিউমের গন্ধ। এমন মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে, অনেকটা চোরের ওপর বাটপাড়ি স্টাইলে রাতের আঁধারে কিংবা আধো-আলোয় চুক্তিগুলো সেরে ফেলছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বার্থ’ রক্ষা করে। তবে সেই স্বার্থটা ঠিক কোন জাতির, ডেনমার্কের, সুইজারল্যান্ডের নাকি বাংলাদেশের, তা নিয়ে সামান্য ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই ধোঁয়াশা দূর করতে যখন চুক্তির কাগজ দেখতে চাওয়া হলো, তখন জানা গেল সেখানে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ বা গোপনীয়তার এক বিশাল তালা ঝুলছে। এ বিষয়ে সরকারের ফেসবুক যোদ্ধা ‘বিনিযোগ-জাদুকর’, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন মুচকি হেসে বলেন, “দেখুন, স্বচ্ছতা মানেই হলো সবকিছু কাঁচের মতো পরিষ্কার হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাই আমরা জনগণকে সেই ধাঁধানো আলো থেকে বাঁচাতে চুক্তির বিষয়গুলো একটু অন্ধকারের চাদরে ঢেকে রেখেছি। এটাকে আপনারা ‘ট্রান্সপারেন্ট ডার্কনেস’ বা স্বচ্ছ অন্ধকার বলতে পারেন। আপনারা শুধু জানবেন, আমরা যা করছি, ফাটিয়ে দিচ্ছি। দেশের চাকা ঘোরানো শুরু হয়েছে, সেই চাকা কোনদিকে ঘুরছে, সামনে না পেছনে, সেটা দেখার দরকার নেই। চাকা তো ঘুরছে, এটাই বড় কথা।”
“ত্রিশ বছরের জন্য বন্দর দিয়ে দিলেন? আমরা কি তবে ত্রিশ বছর আঙুল চুষব?” এমন প্রশ্নের জবাবে বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, “আরে বোকা জাতি! তোমরা আঙুল চুষবে কেন? তোমরা তো এখন বিশ্বমানের সেবা পাবে। আগে যে কন্টেইনার নামাতে তিন দিন লাগত, এখন সেটা ৭২ ঘন্টায় নামবে। তবে হ্যাঁ, খরচটা একটু বাড়বে। বিশ্বমানের সেবা কি আর মাগনা পাওয়া যায়? ডেনমার্কের কোম্পানি তো আর তোমার গ্রামের চাচাতো ভাই না যে ফ্রিতে বস্তা টানবে।”
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, যেই প্রজেক্টগুলো নিয়ে আগের তথাকথিত ‘স্বৈরাচারী’ সরকারের আমলে বর্তমানের বিপ্লবীরা গালমন্দ করতেন, বলতেন, দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হচ্ছে; ক্ষমতায় বসার পর সেই একই প্রজেক্ট এখন ‘পুণ্যকর্ম’ বা ‘সংস্কার’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগের সরকার যখন নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশিদের দিতে চেয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, এরপেছনে আছে অসৎ উদ্দেশ্য। আর এখন বর্তমান সরকার যখন একই কাজ করছে, তখন বলা হচ্ছে, এটি ‘এফিসিয়েন্সি’ বা দক্ষতা বাড়ানোর মহৌষধ। বিষয়টি অনেকটা বোতলের লেবেল বদলানোর মতো। বোতলের ভেতরের তেতো সিরাপ একই আছে, শুধু গায়ের লেবেলে ‘বিষ’ এর জায়গায় ‘ভিটামিন’ লিখে দেওয়া হয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে (কারণ প্রকাশ করলে ইউনূস সরকার মব পাঠিয়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিবে) বলেন, “আমরা তো ভেবেছিলাম সংস্কার মানে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে। এখন দেখছি সক্ষমতা বাড়ানোর মানে হলো আমাদের হাত-পা কেটে বিদেশিদের হাতে রিমোট কন্ট্রোল তুলে দেওয়া। নৌবাহিনী ড্রাইডক দিয়ে চমৎকারভাবে বন্দর চালাচ্ছিল, লাভের টাকা দেশেই থাকছিল। এখন সেই টাকা কনভার্ট হয়ে ডলারে বা ইউরোতে চলে যাবে ইউরোপের কোনো ব্যাংকে। আর আমরা এখানে বসে ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে’ বলে স্লোগান দেব। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই সংস্কার!”
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিদেশ প্রীতির গল্প টাইটানিকের প্রেমকাহিনিকেও হার মানায়। তাদের যুক্তি হলো, আমাদের দেশের মানুষ চোর, বাটপার এবং অদক্ষ। তাই এদের হাতে কিছু রাখা যাবে না। অথচ এই অদক্ষ মানুষগুলোই বিদেশে গিয়ে শ্রম দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের চাকা সচল রাখছে। কিন্তু দেশের ভেতরে কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তাদের দেওয়া যাবে না। লালদিয়া টার্মিনাল ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসকে এবং পানগাঁও বন্দর সুইজারল্যান্ডের মেডলগ কোম্পানিকে দেওয়ার পর এখন শোনা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের হৃৎপিণ্ড নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালও (এনসিটি) দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, যিনি সারা জীবন তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষার জন্য রোদে পুড়ে আন্দোলন করেছেন, তিনি হতাশ গলায় বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম শেখ হাসিনা না থাকলে দেশটা ভাল চলবে। কিন্তু এখন দেখছি ভাল চলা তো দূরের কথা, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর দেশটাই আর আমাদের থাকছে না, ড. ইউনূস দেশটা নিলামে উঠিয়ে দিয়েছে। আগে ছিল ‘ উন্নয়ন এর পাশাপাশি লুটপাট ’, এখন হচ্ছে ‘হ্যান্ডওভারের সংস্কার’। পার্থক্য এটুকুই যে, আগে লুটপাট করত দেশি লোকেরা, দূর্নিতির টাকায় আবার তারা দেশেই ব্যবসা বাণিজ্য করতো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতো, এখন দেশের চাবি অফিশিয়ালি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি জেন্টলম্যানদের হাতে। তারা স্যুট-টাই পরে এসে আমাদের পকেট কাটবে, সেই টাকাকে ডলারে কনভার্ট করে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিবে। আর আমরা সেটাকে ‘স্মার্ট ইকোনমি’ বলে হাততালি দেব।”
এই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিগুলো এমন এক সরকার করছে, যাদের মেয়াদ বা ম্যান্ডেট কোনোটিই দীর্ঘমেয়াদি নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ছিল একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা। কিন্তু তারা এখন ত্রিশ বছরের জন্য দেশের সম্পদ লিজ দিচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সরকারের এক উপদেষ্টা বলেন, “আপনারা বোঝেন না। আমরা যদি এখন চুক্তি না করে দিই, তবে রাজনৈতিক সরকার এসে তো আবার সেই টেন্ডারবাজি শুরু করবে। তার চেয়ে আমরা ভদ্রলোকদের দিয়ে দিই। পরে যদি কোনো সমস্যা হয়? আরে ভাই, তখন কি আমরা থাকব? আমরা তো তখন যে যার মতো অবসরে চলে যাব। জবাবদিহিতা চাইবেন কার কাছে? কাগজের কাছে? চুক্তি তো গোপন! হা হা হা!”
বন্দর বিদেশিদের হাতে যাওয়ার সাথে সাথে ট্যারিফ বা মাশুল বৃদ্ধির যে মহড়া শুরু হয়েছে, তা দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার খালাস করতে গেলে পরিবারের সকলের কিডনি বন্ধক রাখতে হবে। হাইকোর্ট মাশুল বৃদ্ধি স্থগিত করলেও, বিদেশি প্রভুদের পালিত কুকুর যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রেখেছে, তখন সে কি আর হাইকোর্টের কথা শুনবে? ড. ইউনূসের যুক্তি খুব সরল “কোয়ালিটি সার্ভিস দিবে, টাকা তো একটু বেশি নিবেই। তোমরা কি চাও না বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হোক? সিঙ্গাপুরের মতো খরচ করতে শেখো আগে!” সাধারণ জনগণ অবশ্য এই ‘সিঙ্গাপুর’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাজারে গিয়ে পেঁয়াজের দাম শুনেই হার্ট অ্যাটাক করার দশা। তার ওপর যদি আমদানি খরচ বেড়ে পণ্যের দাম আরও বাড়ে, তবে জনগণেরর না খেয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো ‘রিফর্ম’ বা সংস্কার অবশিষ্ট থাকবে না।
যে হারে এবং যে যুক্তিতে বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে আমরা অদূর ভবিষ্যতে আরও কিছু ‘বিপ্লবী’ সংস্কার আশা করতে পারি। যেহেতু আমাদের দেশের ট্রাফিক পুলিশ জ্যাম কমাতে পারছে না, তাই ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব জাপানি কোনো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সচিবালয়ে ফাইল নড়ে না, তাই সচিবালয় পরিচালনার দায়িত্ব জার্মানির কোনো ম্যানেজমেন্ট ফার্মকে দেওয়া হোক। এমনকি, আমাদের সরকার পরিচালনাতেও যেহেতু মাঝেমধ্যেই সমস্যা হয়, তাই আগামী দশ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ‘অ্যামাজন’ বা ‘গুগল’-এর হাতে আউটসোর্স করে দেওয়া যেতে পারে। এতে করে দেশটা পুরোপুরি ‘ডিজিটাল’ ও ‘স্মার্ট’ হবে এবং আমরা জনগণ নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারব যে, আমরা আসলে সুইজারল্যান্ডে আছি!
ধন্য আমাদের সংস্কার, ধন্য আমাদের বিদেশ প্রীতি। নিজেরা কিছু করব না, সব বিদেশিদের দিয়ে দেব, এটাই হোক আমাদের নতুন জাতীয় স্লোগান। আর এই তামাশা দেখার জন্য আমরা জনগণ টিকেট কেটে গ্যালারিতে বসে আছি, চড়া দামে বাদাম চিবুতে চিবুতে ভাবছি, দেশটা আসলে কার? আমাদের, নাকি যাদের সঙ্গে গোপনে চুক্তি হচ্ছে তাদের? উত্তরটা সম্ভবত ওই ‘এনডিএ’ বা গোপন চুক্তির ফাইলের ভেতরেই বন্দি। যা খোলা বারণ!