গোলাম আযম সেই ইতিহাসের মহানায়ক, যে ইতিহাসে বাংলাদেশ নেই। Ghulam Azam can only be a hero in a history from which Bangladesh has been erased.

গণহত্যাকারী রাজাকার-শ্রেষ্ঠ গোলাম আযম ইতিহাসের মহানায়ক নাকি খলনায়ক?

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: বাংলাদেশের ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ের প্রধান খলনায়ক, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র আবদুল্লাহিল আমান আযমী কর্তৃক তাকে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’, ‘ক্ষণজন্মা সাধক’ ও ‘মুকুটহীন রাজা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা কেবল একজন সন্তানের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জ আস্ফালন। এই প্রচেষ্টা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। একজন প্রমাণিত গণহত্যাকারী, যার হাত ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত, তাকে যখন ‘আল্লাহর রহমত’ হিসেবে চিত্রায়িত করার ধৃষ্টতা দেখানো হয়, তখন তা সমগ্র জাতির আত্মসম্মান, ত্যাগ এবং ইতিহাসের প্রতি চরম অবমাননার সামিল।

আবদুল্লাহিল আমান আযমী তার পিতার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথিত গুণাবলি, যেমন সময়ানুবর্তিতা, বিনয়, মৃদুভাষিতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের বর্ণনা দিয়ে এক মায়াবী আখ্যান তৈরির চেষ্টা করেছেন। এই কৌশলটি অত্যন্ত পুরাতন এবং ধূর্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে বড় বড় স্বৈরশাসক ও গণহত্যাকারীদের ব্যক্তিগত জীবনেও এমন তথাকথিত ‘মানবিক’ গুণের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির পারিবারিক আচরণ তার অপরাধকে বিন্দুমাত্র লঘু করতে পারে না। একজন মানুষ তার পরিবারের কাছে ‘আদর্শ পুরুষ’ হতে পারেন, কিন্তু সেই একই ব্যক্তি যখন ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হন, তখন ইতিহাস তাকে তার ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে বিচার করে না, বরং তার কৃতকর্ম দিয়েই মূল্যায়ন করে।

গোলাম আযমের কথিত বিনয় বা মৃদুভাষিতা একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কোথায় ছিল, যখন তিনি পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করছিলেন? তার ‘সাহসিকতা’র নমুনা তো জাতি দেখেছে, যখন তিনি অসহায়, নিরস্ত্র মানুষের উপর সশস্ত্র আক্রমণকে সমর্থন জুগিয়েছেন এবং যুদ্ধ শেষে পরাজিত প্রভুদের সাথে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের ছকে বাঁধা রুটিন দিয়ে তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক অপরাধকে আড়াল করার প্রচেষ্টা কেবল হাস্যকরই নয়, বরং এটি ভয়ঙ্কর প্রতারণা। ইতিহাস সাক্ষী, গোলাম আযমের মূল পরিচয় তার পারিবারিক জীবন নয়, তার মূল পরিচয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।

দেখুন: আবদুল্লাহিল আমান আযমী তার পিতা গোলাম আযমমের যে প্রতিচ্ছবি তরুণ প্রজন্মকে দেখাতে চায়!

ঐতিহাসিক দলিলে গোলাম আযম: এক গণহত্যাকারীর মুখচ্ছবি

ইতিহাস কোনো ব্যক্তিগত ডায়েরি বা পারিবারিক আখ্যানের উপর নির্ভর করে নির্মিত হয় না। ইতিহাস নির্মিত হয় তথ্য, প্রমাণ, দলিল এবং গণমানুষের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। সেই নিরিখে গোলাম আযম ইতিহাসের মহানায়ক নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ঘৃণিত চরিত্র।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক বিরোধিতা: গোলাম আযম এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারণার ঘোর বিরোধী ছিল। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ‘ইসলামবিরোধী’ এবং মুক্তিযুদ্ধকে ‘হিন্দুস্তানের ষড়যন্ত্র’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে প্রচার করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সাথে একাধিক বৈঠক করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের পরামর্শ দেন। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে

সহযোগী ঘাতক বাহিনী গঠন: ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার পর গোলাম আযম সেই হত্যাযজ্ঞকে শুধু সমর্থনই করেননি, বরং তা বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল কুখ্যাত ‘শান্তি কমিটি’, ‘আল-বদর’ ও ‘আল-শামস’ বাহিনী। শান্তি কমিটির কাজ ছিল শহর ও গ্রাম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা, তাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীকে তথ্য দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের চিহ্নিত করে তাদের উপর নির্যাতন চালানো।

অন্যদিকে, আল-বদর বাহিনী ছিল একটি নারকীয় জল্লাদ বাহিনী, যা মূলত জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের(বর্তমান ইসলামি ছাত্রশিবির) সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের (শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক ও শিল্পীদের) পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করে দেওয়া। ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল এই আল-বদর বাহিনী, যার আদর্শিক পিতা ছিলেন গোলাম আযম। তার নির্দেশ ও অনুপ্রেরণাতেই এই ঘাতক বাহিনীগুলো সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোলাম আযম কেবল দেশের ভেতরেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সফর করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চালানো গণহত্যাকে ‘ধর্ম রক্ষা’ ও ‘দেশ রক্ষার’ লড়াই হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হচ্ছে না, বরং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী  দুষ্কৃতকারী’ দমন করছে। এটি ছিল সত্যের বিরুদ্ধে এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার এবং নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা।

ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতি ও তার পরিণতি

গোলাম আযমকে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ বানানোর প্রচেষ্টা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সেই পরাজিত শক্তির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ, যারা একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পারেনি। এই বিকৃতির মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা: যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, সেই তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের একটি বিকৃত ও মিথ্যা সংস্করণ তুলে ধরে তাদের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে দুর্বল করে দেওয়া।
  • যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা: যুদ্ধাপরাধীদের ‘মহান নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাদের বিচার প্রক্রিয়াকে একটি ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ হিসেবে চিত্রায়িত করার অপচেষ্টা চালানো।
  • সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনর্বাসন: গোলাম আযমের রাজনীতি ছিল ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক। তাকে মহিমান্বিত করার অর্থ হলো, যে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই চেতনাকে আঘাত করে আবার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ রোপণ করা।
  • শহীদদের আত্মত্যাগকে অপমান করা: একজন গণহত্যাকারীকে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ বলা ত্রিশ লক্ষ শহীদ, চার লক্ষ বীরাঙ্গনা এবং কোটি কোটি মুক্তি সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগের প্রতি চরম অপমান।

ইতিহাসের আদালতে গোলাম আযমের বিচার হয়ে গেছে। তিনি কেবল একজন যুদ্ধাপরাধীই নন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে এক আদর্শিক ষড়যন্ত্রকারী, গণহত্যাকারী এবং চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতক। কোনো সন্তানের ব্যক্তিগত আবেগ কিংবা কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক প্রচারণা ইতিহাসের এই অলঙ্ঘনীয় সত্যকে বিন্দু পরিমাণও মুছে ফেলতে পারবে না। যারা আজ তাকে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তারা কী ভেবেছে এদেশের জনগণ বিস্মৃত হয়েছে যে, এই গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ মদদ ও নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল কুখ্যাত ‘শান্তি কমিটি’, ‘আল-বদর’ ও ‘আল-শামস’ এর মতো জল্লাদ বাহিনী। তারা কী ভেবেছে এদেশের জনগণ বিস্মৃত হয়েছে যে, এই বাহিনীগুলোই পাকিস্তানি হানাদারদের পথ দেখিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মুক্তিকামী বাঙালিদের তালিকা তৈরি করে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি জল্লাদদের হাতে এবং চালিয়েছে অকথ্য নির্যাতন।

বিশেষ করে তার আদর্শে পুষ্ট আল-বদর বাহিনীর হাতে সংঘটিত ১৪ই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার এক পরিকল্পিত নীলনকশা। যখন তার নির্দেশে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চোখ বেঁধে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তার কথিত ‘বিনয়’ বা ‘মৃদুভাষিতা’ কোথায় ছিল? গোলাম আযমের নাম কোনো বীরত্বের ইতিহাসে নয়, লেখা থাকবে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে, বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিটি দলিলে।

পৃথিবীর মানচিত্রে যতদিন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সগৌরবে টিকে থাকবে, ততদিন গোলাম আযমের নাম কেবল ঘৃণার সাথেই উচ্চারিত হবে। গোলাম আযম ইতিহাসের মহানায়ক বা ‘মুকুটহীন রাজা’ নন, তিনি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এক ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী, যার হাতে লেগে আছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর চার লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানীর কলঙ্ক।

যারা আজ ইতিহাস বিকৃত করে নিজেদের পাপিষ্ঠ পিতাকে নায়ক বানানোর ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, তাদের মনে রাখা উচিত, সত্যকে সাময়িকভাবে ধামাচাপা দেওয়া গেলেও চিরতরে মুছে ফেলা যায় না। বাংলার মাটি ও মানুষ গোলাম আযম এবং তার দোসরদের কখনো ক্ষমা করবে না, কারণ এই রক্তের দাগ ক্ষমার অযোগ্য। তাদের স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে এবং চিরকাল থাকবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই। এই ধরনের নির্লজ্জ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে সজাগ থাকা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরাই এখন প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব।