সংস্কার করে যাক না কটা দিন থেকে এই করে খাবি কয়দিন: ড. ইউনূস প্রযোজিত একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার।
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: গ্রামের নাম ‘বাংলাদেশ’। অদ্ভুত এক গ্রাম। এই গ্রামের মানুষেরা বড়ই আবেগপ্রবণ, আবার বড়ই বিস্মৃতিপরায়ণ। এই গ্রামে একদিন কুয়াশাভেজা সকালে উদয় হলেন এক জাদুকর। তবে তিনি টিপিক্যাল জাদুকর নন, টুপি থেকে খরগোশ বের করেন না। তার জাদুর ধরনটা একটু ভিন্ন, যাকে আধুনিক পরিভাষায় বলা হয় ‘মাইক্রো-ম্যাজিক’।
চেহারাটা মাঝারি গড়নের, দেখলে মনে হয় অভিজ্ঞতার ভারে ন্যুব্জ, যেন দুই পা কবরে আর এক পা প্যারিসের বিমানে। চোখে এক ধরণের কুবুদ্ধির ঝিলিক, যেটা চশমার লেন্সের আড়ালে মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের মতো চমকায়। পরনে সাধাসিধে পোশাক, পায়ে নগ্ন পদযুগল, যেন মাটির সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপনের এক নিদারুণ চেষ্টা। কাঁধে ঝোলানো এক বিশাল পুরনো পুটলি। সেই পুটলিটি সাধারণ কোনো কাপড়ের পোঁটলা নয়; ওটা হলো ‘সংস্কারের ঝোলা’।
জনশ্রুতি আছে, ওই পুটলির ভেতরে রয়েছে এক আশ্চর্য ‘মাইক্রোফাইন্যান্সের পুরনো ক্ষুর’। এই ক্ষুর দিয়ে নাকি তিনি দারিদ্র্যকে এমনভাবে শেভ করে দেন যে, দরিদ্র মানুষ আর নিজেকে দরিদ্র বলে চিনতেই পারে না। আর আছে পথিমধ্যে খাওয়ার জন্য বিদেশি ফান্ডের তৈরি বিশেষ মুড়ি আর গুড়। এই মুড়ি খেলে পেটে ক্ষুধা থাকে না, থাকে শুধু ‘থ্রি-জিরো’র স্বপ্ন।
ভদ্রলোকের নাম ড. ইউনূস। তবে গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে আদর করে ডাকেন ‘গ্রামের মহাজন’ বা ‘সুদখোর সাধু’, যদিও তিনি নিজেকে পরিচয় দেন ‘চিফ রিফর্মার’ বা ‘প্রধান সংস্কারক’ হিসেবে। তার পেশা? খুব সহজ এবং একই সাথে অত্যন্ত জটিল, পেশা তার ‘সংস্কার’।
তিনি গ্রামে ঢুকেই হাঁক দিলেন, ‘সংস্কার! টাটকা সংস্কার! সংবিধান কাটা-ছেঁড়া থেকে শুরু করে ডিমের দাম কমানোর সংস্কার! সব আছে, সব মিলবে! শুধু জপতে হবে এক মন্ত্র!’
গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো তখন এক বিশাল পরিবর্তনের ঘোরের মধ্যে ছিল। তারা ড. ইউনূসের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তিনি তখন দুই হাত আকাশে তুলে, চোখ বন্ধ করে জপতে শুরু করলেন তার সেই জাদুকরী মন্ত্র:
‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন… আহা, সংস্কার করে যাক না কটা দিন!’
তার ভরাট গলার আওয়াজে গ্রামের বাতাস প্রকম্পিত হলো। তিনি বললেন, দেখো হে বাপুসকল, এই যে চালের দাম বাড়ছে, এই যে তেল নাই, এই যে তোমাদের পকেটে গড়ের মাঠ, এসবের কারণ হলো সিস্টেমের ভাইরাস। আমি এসেছি অ্যান্টিভাইরাস নিয়ে। আমার এই সংস্কারের ক্ষুর দিয়ে আমি সিস্টেমের সব জঞ্জাল চেঁছেপুছে সাফ করে দেব। শুধু আমাকে সময় দাও, আর জপতে থাকো, ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন।’
গ্রামের মানুষ প্রথম প্রথম মহা খুশি। তারা ভাবল, এত বড় জ্ঞানী মানুষ, নোবেল-টোবেল পাওয়া লোক, ইনি যখন বলছেন, তখন নিশ্চয়ই এই ক্ষুর দিয়ে আমাদের ভাগ্য চকচকে করে দেবেন। শুরু হলো হাততালি। কেউ ঘর থেকে এক মুঠো চাল এনে তার ঝুলিতে দিল, কেউ দিল পুকুরের তাজা মাছ, কেউ বা পকেটের শেষ পাঁচ-দশটা টাকা তার মাইক্রো-তহবিলে জমা দিল। কেউ কেউ তো আবেগে কাঁদতে কাঁদতেই জপতে শুরু করল, ‘ওরে, সংস্কার করে যাক না কটা দিন!’
ড. ইউনূসের মুখে তখন বিশ্বজয়ী হাসি। পকেট ভারী হচ্ছে, বিদেশি ফান্ডের মুড়ি চিবোতে চিবোতে তিনি ভাবলেন, ব্যবসাটা মন্দ না।
এভাবে কেটে গেল দেড় বছর। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়, কিন্তু গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পাতা আর উল্টায় না। প্রতিদিন সকালে ড. ইউনূস তার ঝোলা কাঁধে বের হন। গ্রামের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে সেই একই পুরনো রেকর্ড বাজান, ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন।’
তিনি এক জায়গায় বসেন, ঝোলা থেকে তার সেই পুরনো ক্ষুর বের করেন। তারপর ঘোষণা দেন, ‘আজ আমরা পুলিশি ব্যবস্থার দাড়ি কামাবো।’ পরদিন বলেন, ‘আজ আমরা বিচার বিভাগের গোঁফ ছাঁটবো।’ তার পরের দিন বলেন, ‘আজ আমরা নির্বাচন কমিশনের চুল ব্লিচ করে সোনালী করে দেব।’
কমিশনের পর কমিশন গঠন হয়। তদন্ত কমিটি হয়, টাস্কফোর্স হয়। গ্রামের মানুষ গোল হয়ে বসে দেখে, কীভাবে তিনি হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাচ্ছেন। কিন্তু দিন শেষে বাজারে গিয়ে দেখে, আলুর দাম সেঞ্চুরি পার করেছে, ডিমের হালি কিনতে গেলে পকেটে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা। টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সারি গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে পাশের ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে গেছে। বেকার যুবকরা চাকরির আশায় তার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর তিনি মুচকি হেসে বলেন, “চাকরি তো পুরোনো কনসেপ্ট। তোমরা উদ্যোক্তা হও, আমার কাছে ঋণ নাও, আর সংস্কারের গান গাও।”
গ্রামবাসী আগে উঁচু স্বরে জপতো সংস্কারের মন্ত্র, এখন মিনমিন করে জপে। পেটে ভাত নেই, তাই গলার স্বর নিচু হয়ে গেছে। ড. ইউনূস তখন গম্ভীর মুখে বলেন, ধৈর্য ধরো বাছারা। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আগের জমিদাররা সব খেয়ে গেছে। আমি তো শুধু ঝাড়ু দিচ্ছি। ঝাড়ু দিতে একটু ধুলা তো উড়বেই। চোখ বন্ধ করে রাখো, আর জপতে থাকো, ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন।’
ঠিক এমন এক ক্রান্তিলগ্নে, যখন গ্রামের মানুষের ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে যাচ্ছে, তখন গ্রামে এল এক পণ্ডিত পথিক। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে ফতুয়া, চোখে চশমা। সে ঘুরতে ঘুরতে দেখল, গ্রামের মানুষ এখনো জম্বির মতো মিনমিন করে জপছে, ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন… সংস্কার করে যাক না কটা দিন…’
পথিক অবাক হলো। সে গ্রামের চা-দোকানে বসল (যেখানে চিনির অভাবে এখন শুধু লাল চা পাওয়া যায়)। এক চুমুক চা খেয়ে সে পাশে বসা এক গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, ঘটনা কী? তোমাদের শরীর শুকিয়ে কাঠ, পরনে তালি দেওয়া কাপড়, কিন্তু মুখে এই অদ্ভুত মন্ত্র কেন? গ্রামবাসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর বলবেন না ভাই। ওই যে দেখছেন ঝোলা কাঁধে ভদ্রলোক, উনি বলেছেন এই মন্ত্র জপলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। উনি সংস্কার করছেন।
পথিক হেসে কুটিপাটি। সে বলল, আরে বোকার দল! সংস্কার কি মন্ত্র জপলে হয়? সংস্কার হলো কাজের জিনিস। আর দেড় বছর ধরে যে গান শুনে যাচ্ওছো ওটা তো পুরানো হয়ে গেছে। ওটা এখন আর চলে না।
গ্রামবাসী উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমরা কী করব? আমাদের তো আর কোনো মন্ত্র জানা নেই।
পথিক মুচকি হেসে বলল, দাঁড়াও, তোমাদের নতুন মন্ত্র শেখাই। এই মন্ত্রটা হলো রিয়েলিটি চেক মন্ত্র। কাল সকালে যখন ড. ইউনূস আবার ওই ভাঙা রেকর্ড বাজাবে, তোমরা সবাই মিলে সমস্বরে এই নতুন মন্ত্রটা বলবে বলেই পথিক তাদের কানে কানে শিখিয়ে দিল সেই মোক্ষম লাইন, ‘এই করে খাবি কয়দিন!’
গ্রামবাসীর চোখ চকচক করে উঠল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। মনে হলো, এতদিনের ক্ষুধার্ত পেটে কেউ বিরিয়ানির গন্ধ এনে দিয়েছে। সারা রাত ধরে গ্রামে চলল ফিসফিসানি, চলল রিহার্সাল।
পরদিন সকাল। সূর্য তখনো ভালো করে ওঠেনি। ড. ইউনূস তার সেই বিখ্যাত নগ্ন পায়ে, কাঁধে ঝোলানো পুটলি নিয়ে গ্রামে হাজির হলেন। তার চোখেমুখে সেই চেনা আত্মবিশ্বাস। তিনি ভাবছেন, আজও হয়তো গ্রামের মানুষ তাকে চাল-ডাল-টাকা দেবে আর মন্ত্র জপবে।
তিনি একটি উঁচু টুলের ওপর দাঁড়ালেন। মাইক্রোফোন (যেটা আসলে একটা ভাঙা টিনের চোঙা) হাতে নিয়ে তিনি শুরু করলেন, প্রিয় গ্রামবাসী, শুভ সকাল! আমি জানি তোমরা কষ্টে আছ, কিন্তু মনে রেখো, রাত যত গভীর হয়, ভোর তত কাছে আসে। আমার হাতে এই যে দেখছ ফাইল, এটা হলো ‘রাস্তাঘাট মেরামতের সংস্কার কমিশন-এর সাব-কমিটির খসড়া প্রস্তাবনা’। এটা পাস হতে আরও ছয় মাস লাগবে। ততদিন তোমরা ধৈর্য ধরো, আর আমার সাথে বল…”
তিনি গভীর শ্বাস নিলেন, আশা করছিলেন সমস্বরে আওয়াজ আসবে ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন’।
কিন্তু হায়!
হঠাৎ গোটা গ্রাম যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। বাচ্চা থেকে বুড়ো, কিষান থেকে কিষানি, রিকশাওয়ালা থেকে স্কুল মাস্টার, সবাই একসাথে এক সুরে, এক লয়ে, এক ছন্দে চেঁচিয়ে উঠল:
‘এই করে খাবি কয়দিন… এই করে খাবি কয়দিন!’
ড. ইউনূস চমকে উঠলেন। তার হাতের টিনের চোঙাটা কেঁপে উঠল। তিনি ভাবলেন, হয়তো ভুল শুনেছেন। তিনি আবার বললেন, ‘না না, মন্ত্র ভুল হচ্ছে। তোমরা বলবে ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন।’
জনতা এবার আরও জোরে, আরও দ্বিগুণ উৎসাহে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে স্লোগান দিল:
‘এই করে খাবি কয়দিন… ওরে বাটপার, এই করে খাবি কয়দিন!’
ড. ইউনূসের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। তার কুবুদ্ধির ঝিলিক দেওয়া চোখ দুটো হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, তার ‘মাইক্রো-ম্যাজিক’ আর কাজ করছে না। বিদেশি ফান্ডের মুড়ি দিয়ে আর পাবলিকের পেট ভরানো যাবে না। পাবলিক এখন আসল ভাত চায়।
তিনি এদিক-ওদিক তাকালেন। দেখলেন, কেউ আর চাল-ডাল নিয়ে এগিয়ে আসছে না। বরং কয়েকজন পচা ডিম আর টমেটো হাতে নিয়ে দূর থেকে মাপজোখ করছে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ড. ইউনূস আস্তে করে টুল থেকে নামলেন। তার ঝোলাটা কাঁধে ভালো করে বাগিয়ে নিলেন। তারপর আর কোনো কথা না বলে, কোনো দিকে না তাকিয়ে, সোজা হাঁটা দিলেন প্যারিসের বিমান ধরতে।
তিনি দ্রুতপায়ে হাঁটছেন। তার নগ্ন পায়ে ধুলো উড়ছে। আর তার পিছনে ভেসে আসছে গ্রামবাসীর সেই নতুন মন্ত্র, যা এখন বাতাসের সাথে মিশে প্রতিধ্বনিতে পরিণত হয়েছে:
‘এই করে খাবি কয়দিন… এই করে খাবি কয়দিন…’
দূরে যেতে যেতে ড. ইউনূস বিড়বিড় করে বললেন, এরা বড় অকৃতজ্ঞ। এত সুন্দর একটা থিওরি দিলাম, এতগুলো কমিশন দিলাম, আর ওরা কি না ভাতের হিসাব চায়! যাই, প্যারিসে গিয়ে ম্যাকঁ-র সাথে কফি খেয়ে আসি। এই দেশে কদর নেই গুণের।
গ্রামের মোড়ে দাঁড়িয়ে সেই পণ্ডিত পথিক তখনো হাসছে। আর গ্রামের মানুষ? তারা হয়তো আজও সংস্কারের আশা ছাড়েনি, তবে তারা এখন আর অন্ধের মতো মন্ত্র জপে না। তারা এখন হিসাব চায়, আর মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠে:
“দিন যে গেল,
সন্ধ্যা হলো, সংস্কারের বাতি জ্বলে না,
কথার ফুলঝুড়ি আর কতকাল?
পেট তো কথা শোনে না!”