
যমুনায় জুস পার্টি: মাইলস্টোনের শোকে যিনি হাসেন, পোপের শোকে তিনিই ভ্যাটিকান ছোটেন
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: সম্প্রতি দেশের বিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক ও সাধারণ চা-দোকানের টং-তাত্ত্বিকদের মধ্যে এক মহা ধাঁধার উদ্ভব হয়েছে। বিষয়টি পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের নয়, বরং মানব অনুভূতির এক জটিল সমীকরণের। প্রশ্নটি অতি সাধারণ, কিন্তু উত্তরটি মহাজাগতিক পর্যায়ের জটিল: একই মানব চক্ষুগোলক থেকে কিছুদিন আগে রোমের পোপের জন্য কান্নার যে নোনা জলের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, সেই একই চক্ষু থেকে ঢাকার মাইলস্টোনের শিশুদের জন্য এক ফোঁটা জলও না ঝরে কীভাবে হাসির ঝিলিক বেরিয়ে এলো? এই ধাঁধার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আমাদের এক এবং অদ্বিতীয় প্রধান উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক কান্নাকাটি বোর্ডের সাবেক সভাপতি ও সাম্প্রতিক হাসিখুশি সংঘের প্রধান সেনাপতি, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস।
আসুন আমরা একটু অতীতে ফিরে যাই। বেশিদিন আগের কথা নয়। বিশ্ব যখন পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে শোকাহত, তখন সেই শোকের ঢেউ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জোরে আছড়ে পড়েছিল একজনের হৃদয়ে। তিনি আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। পোপের মৃত্যুতে তিনি এতটাই শোকার্ত হয়েছিলেন যে, তার শোকবার্তায় ব্যবহৃত ‘ভারাক্রান্ত’, ‘গভীর সমবেদনা’, ‘ঐক্যের আলোকবর্তিকা’র মতো ভারী ভারী শব্দে দেশের বাতাসের চাপ বেড়ে গিয়েছিল। তার কান্নাভেজা সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও চোখে জল আসে। তিনি শুধু শোক প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি, তার কান্নার বেগ এতটাই তীব্র ছিল যে, সেই বেগ সামলাতে না পেরে তিনি সোজা উড়াল দিয়েছিলেন ভ্যাটিকান সিটির পথে। তার সেই যাত্রা ছিল এক ঐতিহাসিক ‘শোকতীর্থ যাত্রা’। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিনি পোপের জন্য যে পরিমাণ চোখের জল ফেলেছেন, তা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি নতুন ‘স্যালাইন ওয়াটার মাইক্রোক্রেডিট’ প্রকল্প চালু করা যেত।
সেই সময় জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, আহা! কী অনুভূতিপ্রবণ একজন নেতা পেয়েছি আমরা! যার হৃদয়ের মানচিত্র জুড়ে গোটা বিশ্ব। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যার কান্না রোম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তিনি নিশ্চয়ই দেশের মানুষের দুঃখে আরও বেশি কাতর হবেন। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম যে, এই মানুষটির চোখের জল হবে আমাদের সকল দুঃখ ধুয়ে দেওয়ার ঝর্ণাধারা।
কিন্তু হায়! কে জানত যে, তার কান্নারও নিজস্ব ভূগোল ও ক্যালেন্ডার রয়েছে!
এবার আসুন বর্তমানের রুক্ষ বাস্তবতায়। কিছুদিন পরেই ঘটলো মাইলস্টোনের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা। পুড়ে ছাই হয়ে গেল অজস্র নিষ্পাপ শিশু। গোটা দেশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে, স্বজনদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী, তখন আমাদের সেই ‘অনুভূতিপ্রবণ’ নেতার দিকেই তাকিয়ে ছিল সবাই। জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ভ্যাটিকান কাঁপানো সেই কান্নার একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখার জন্য। মানুষ ভেবেছিল, পোপের জন্য যিনি সাগরের জল চোখে আনতে পারেন, তিনি দেশের শিশুদের জন্য অন্তত এক বালতি জল তো ফেলতেই পারেন!
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে যা ঘটলো, তা পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্রকে হার মানায়। রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে যমুনা অতিথি ভবনে জুস পার্টিতে আমাদের সেই কান্নারত্ন, সেই শোকসম্রাট হাজির হলেন এক নতুন রূপে। তার চোখে জল ছিল না, মুখে ছিল না বিষাদের ছায়া। পরিবর্তে, তার পুরো মুখমণ্ডল জুড়ে ছিল এক নির্মল, ফটোজেনিক হাসি। যে হাসি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি কোনো জাতীয় শোকসভায় নয়, বরং নিজের কোনো নতুন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফিতা কাটতে এসেছেন।
এই দৃশ্য দেখার পরই দেশের বৈজ্ঞানিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই আবেগীয় বৈপরীত্যের কারণ অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব উঠে এসেছে:
১. কান্নার কোটা তত্ত্ব: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের কান্নার একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক কোটা থাকে। ডক্টর ইউনূস পোপের মৃত্যুতে এতটাই উচ্চমানের কান্না কেঁদেছেন যে, তার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কান্নার সম্পূর্ণ কোটা পূরণ হয়ে গেছে। ফলে মাইলস্টোনের জন্য কান্নার কোনো রিজার্ভ অবশিষ্ট ছিল না।
২. আন্তর্জাতিক বনাম লোকাল কান্না প্যাকেজ: এই হাইপোথিসিস বলছে, স্যারের অনুভূতির একটি ‘গ্লোবাল রোমিং’ প্যাকেজ অ্যাক্টিভেট করা আছে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দুঃখে তার হৃদয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কানেক্ট হয়ে যায়। কিন্তু ‘লোকাল’ বা দেশীয় ট্র্যাজেডির জন্য তার কোনো প্যাকেজ কেনা নেই। ফলে মাইলস্টোনের ঘটনায় তার ইমোশন ‘নো সিগন্যাল’ দেখাচ্ছিল।
৩. ভিআইপি শোক প্রটোকল: এই তত্ত্বটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটি অনুসারে, প্রধান উপদেষ্টার শোকানুভূতি কেবল তখনই কাজ করে, যখন মৃত ব্যক্তির আন্তর্জাতিক খ্যাতি বা ‘গ্লোবাল ফেম ইনডেক্স’ ৭.০-এর উপরে থাকে। পোপ ফ্রান্সিস সেই স্কেলে ১০/১০ পাওয়ায় কান্নার বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাইলস্টোনের শিশুরা যেহেতু কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতেনি, তাই প্রটোকল অনুযায়ী তাদের জন্য হাসিমুখে সমবেদনা জানানোই যথেষ্ট ছিল।
এই ঘটনাপ্রবাহে দেশের সাধারণ মানুষ পড়েছে চরম বিভ্রান্তিতে। ফেসবুকের এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পোপের জন্য কান্নার স্টক কি আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মাইলস্টোনের জন্য এক ফোঁটাও ‘কান্না-লোন’ করা যেত না?” আরেকজন লিখেছেন, “বুঝলাম, উনি পাইকারি দরে কাঁদেন। একবার কেঁদে কয়েক মাসের সাপ্লাই শেষ করে ফেলেছেন।”
সর্বোপরি, ডক্টর ইউনূস আমাদের শিখিয়েছেন যে, কান্নারও একটি স্ট্যান্ডার্ড, ক্লাস বা মান রয়েছে। সব লাশের ওপর কাঁদা যায় না। কাঁদতে হলে এমন কারো জন্য কাঁদতে হবে, যার জন্য কাঁদলে আন্তর্জাতিক সম্মান বাড়ে। দেশের পুড়ে যাওয়া শিশুদের জন্য কাঁদলে তো আর নোবেলের দাম বাড়ে না! তাই আসুন, আমরা আমাদের নেতার এই নতুন দর্শনকে সাধুবাদ জানাই এবং পরবর্তী জাতীয় দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করি। কে জানে, হয়তো ততদিনে তার কান্নার কোটা আবার রিফিল হয়ে যেতে পারে!