বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: দেশজুড়ে যখন কান্নার রোল, রাজধানীর বাতাস যখন পোড়া মাংস আর স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারাক্রান্ত, ঠিক তখনই দেশের ভাগ্য নির্ধারণের সদর দফতর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আবিষ্কৃত হলো শোক পালনের এক যুগান্তকারী কৌশল। শোককে শক্তিতে নয়, বরং হাসিতে রূপান্তর করার এই অভিনব পদ্ধতির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘যমুনা মেথড’। মঙ্গলবার সারাদিনব্যাপী মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির রাষ্ট্রীয় শোক পালন শেষে সন্ধ্যায় এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা।
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন স্বয়ং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ক্ষুদ্রঋণের জনক ও বৃহৎ হাসির খলনায়ক, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অশান্তির ফেরিওয়ালা, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক বিতারিত প্রতিষ্ঠাতা ও যমুনা গেস্ট হাউজের রসিক চূড়ামণি ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই যিনি কান্নাভেজা গলায় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে শোকবার্তা দিয়েছিলেন, তার সেই শোকবিহ্বল চেহারা যমুনার বৈঠকে এসে যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যায়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠতেই তার মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক, যা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বুঝি সদ্য ২য় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কোনো জাতীয় দুর্যোগের পর বৈঠকে বসেননি।
বৈঠকে তার হাসির প্রধান সঙ্গী ছিলেন বৃহত্তর জামায়াতের বিএনপি শাখার ভাঁড়মুক্ত মহানায়েব, জাতীয়তাবাদী কান্নাকাটি বোর্ডের মহাসচিব, কান্নার ফাঁকে মুচকি হাসির অগ্রদূত আল্লামা মির্জা ফখরুল ইসলাম আগুনগীর। যিনি সাধারণত সামান্য রাজনৈতিক কারণে বা প্রশ্নের মুখে পড়লেই রুমালে চোখ মুছতে শুরু করেন, সেই তিনিই মাইলস্টোনের মতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডির দিনে এমন নির্মল হাসি উপহার দিলেন, যা দেখে উপস্থিত সাংবাদিকরা পর্যন্ত দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন, আজ কি আসলেই রাষ্ট্রীয় শোক দিবস, নাকি কোনো কমেডি ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান!
এই দুই মহারথীর সঙ্গে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং নব্য গঠিত পাকিস্তানপন্থী কিংস পার্টি এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) শীর্ষ নেতারা। তাদের মুখেও ছিল না শোকের লেশমাত্র। কালো ব্যাজ নামক সেকেলে শোকের প্রতীক তো দূরের কথা, তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল তারা কোনো বন্ধুর বিয়েবাড়িতে এসে হালকা মেজাজে খোশগল্পে মেতেছেন। ফটোজেনিক হাসির সঙ্গে সঙ্গে চলছিল ঠান্ডা জুস ও মুখরোচক খাবারের অবিরাম সরবরাহ। যেন মাইলস্টোনের নিহত শিশুদের আত্মার শান্তি কামনায় নয়, বরং নেতাদের হজমশক্তির শান্তি কামনায় এই ‘আনন্দসভা’ আয়োজন করা হয়েছিল।
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার সকালে। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের তালিকা প্রকাশ, সুষ্ঠু চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা উপদেষ্টার অপসারণের দাবিতে যখন শিক্ষার্থীরা রাজপথ উত্তাল করে তুলেছিল, তখন সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও টকশোর সাবেক গরম বক্তা এবং বর্তমান সরকারের আইন উপদেষ্টা ডক্টর আসিফ নজরুল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পণ্ডিত ও শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার টানা নয় ঘণ্টা মাইলস্টোনে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার অবরোধে আটকা পড়েন। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও। একদিকে ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছে, অন্যদিকে উপদেষ্টা মহোদয়রা ভেতরে বসে ভাবছিলেন এই জাতিকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নেওয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি। বিকেলে অবশ্য শত শত পুলিশের কঠোর নিরাপত্তায় তাদের উদ্ধার করা হয়। এই উদ্ধার অভিযান দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করা হচ্ছে, নিজের দেশের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নয়।
সারাদিনব্যাপী এই চরম উত্তেজনার পর সন্ধ্যায় যমুনায় যখন বৈঠক শুরু হলো, তখন সকলেই ভেবেছিলেন হয়তো একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করবে। হয়তো নেতারা গম্ভীর মুখে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজবেন। কিন্তু দেশের মানুষকে আবারও ভুল প্রমাণ করে দিলেন তারা। বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতাদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করে এবং তা ধীরে ধীরে অট্টহাসিতে রূপ নেয়। ডক্টর ইউনূসের সেই বিখ্যাত হাসি, যা একসময় বিল ক্লিনটনের মতো বিশ্বনেতাদের মুগ্ধ করত, তা এবার দেশের শোকাহত মানুষকে হতভম্ব করে দিল। তার হাসির মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, মির্জা ফখরুলও তার বহু বছরের কান্নার অভ্যাস ভুলে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে বাধ্য হন।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় আসল তোলপাড়। শত শত প্রোফাইল থেকে লেখা হয় এক লাইনের একটি পোস্ট “নাটক কম করো পিও“। প্রবাসী জেমস বন্ড সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ভিডিওটি শেয়ার করে তার স্বভাবসুলভ ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, “এই লোকগুলোর কি কোন লাজলজ্জা নাই? কোন মনুষ্যত্ববোধ নাই? ভেটকাইতেছে বসে বসে।” তার এই পোস্টে ফেসবুকিয়া জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। একজন লিখেছেন, “ডেল কার্নেগী বেঁচে থাকলে আজ একটা নতুন বই লিখতেন ‘কীভাবে সন্তানের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে হাসবেন ও নেতৃত্ব দেবেন’।” আরেকজন রসিকতা করে লিখেছেন, “হাসি দেখলে মনে হয় মাইলস্টোনে বিমান নয়, তাদের প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ক্র্যাশ করেছে।”
শুধু সাধারণ মানুষই নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই ঘটনায় মুখ খুলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক লিখেছেন, “রাষ্ট্রীয় শোক চলছে। কেউ কিভাবে হাসবেন?” এই প্রশ্নটিই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সারা দেশে। এত হাসি কোথা থেকে আসে? যেখানে মাইলস্টোনের পোড়া শিশুদের মুখ মনে পড়লে সাধারণ মানুষের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, সেখানে দেশের কর্ণধাররা কোন জোকস শুনে এত হাসতে পারেন? তাদের এই হাসি কি নিহত শিশুদের অপমান নয়? গোটা মানবতার অপমান নয়?
এইসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য নেতারা দেননি। হয়তো তারা জুস ও স্ন্যাকস খেতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, এসব ছোটখাটো বিষয়ে ভাবার সময় পাননি। কিংবা হয়তো তারা সত্যিই শোক পালনের এক নতুন দর্শন আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যেখানে কান্নার বদলে হাসিই হলো শোক প্রকাশের সর্বোচ্চ মাধ্যম। যদি তাই হয়, তবে বলাই বাহুল্য, তারা প্রত্যেকেই এই নতুন ধারার শোক পালনে গোল্ড মেডেল পাওয়ার যোগ্য। ভবিষ্যতে হয়তো রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে কালো ব্যাজের পরিবর্তে মুখে বাধ্যতামূলক হাসি ঝুলিয়ে রাখার আইনও পাস হতে পারে। সেদিন হয়তো আমরা এই ‘যমুনা মেথড’এর আসল মাহাত্ম্য বুঝতে পারব।
#Cartunus Daily, #অন্তর্বর্তী সরকার, #আসিফ নজরুল, #কার্টুনুস ডেইলি, #ছাত্র বিক্ষোভ, #জামায়াত, #জুলকারনাইন সায়ের, #ড. ইউনূস, #ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, #দৈনিক কার্টুনুস, #বাংলাদেশের রাজনীতি, #বিএনপি, #মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি, #মাইলস্টোন বিমান দুর্ঘটনা, #মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, #মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, #যমুনা অতিথি ভবন, #রাজনৈতিক রম্য, #রাষ্ট্রীয় শোক, #শিশু মৃত্যু, #সি আর আবরার