ড. ইউনূসের সংস্কারের জাদুকরী মন্ত্র বনাম পাবলিকের রিয়ালিটি চেক: প্রসঙ্গ এনিমেটেড শর্ট ফিল্ম ‘সংস্কার করে যাক না কটা দিন’।
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আশা এবং হতাশা এ দুটির পার্থক্য করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ সর্বদা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে যখন দীর্ঘসূত্রিতা আর অজুহাতের পাহাড় জমে, তখন জন্ম নেয় তীব্র হাস্যরস বা স্যাটায়ার। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই নির্মিত হয়েছে নতুন অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম— সংস্কার করে যাক না কটা দিন। গ্রামের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং সেখানে ড. ইউনূস নামক এক জাদুকরের আগমনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই গল্পটি কেবল বিনোদন নয়, বরং আমাদের বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতির এক নিখুঁত দর্পণ।
গল্পের প্রেক্ষাপট: গল্পটি শুরু হয় ‘বাংলাদেশ’ নামক এক কাল্পনিক গ্রামে। কুয়াশাভেজা সকালে সেখানে উদয় হন এক জাদুকর। তবে তিনি চিরাচরিত জাদুকর নন; তার ঝোলায় খরগোশ নেই, আছে ‘সংস্কারের’ পুরনো ক্ষুর আর বিদেশি ফান্ডের মুড়ি। গল্পের প্রধান চরিত্র ড. ইউনূস, যাকে গ্রামবাসী চেনে ‘সুদখোর মহাজন’ হিসেবে, তার অবয়ব এবং কর্মকাণ্ড দর্শকদের মনে পরিচিত এক ইমেজের জন্ম দেয়। ঝোলা কাঁধে হাঁটা এই জাদুকর দাবি করেন, তার কাছে আছে এমন এক মন্ত্র, যা দিয়ে তিনি সিস্টেমের সব ভাইরাস দূর করবেন। তার সেই জাদুকরী মন্ত্রটি হলো “সংস্কার করে যাক না কটা দিন।”
প্রতিশ্রুতির পাহাড় বনাম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম: শর্ট ফিল্মটিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে দেখানো হয়েছে কীভাবে সাধারণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করা হয়। জাদুকর বা সংস্কারক যখন একের পর এক কমিশন গঠন করছেন, টাস্কফোর্স বানাচ্ছেন এবং জনগণকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন, তখন অন্যদিকে আলুর দাম সেঞ্চুরি পার করছে এবং ডিম কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। অ্যানিমেশনের প্রতিটি ফ্রেমে ফুটে উঠেছে গ্রামবাসীর অসহায়ত্ব। তারা জাদুকরের কথায় বিশ্বাস করে পকেটের শেষ সম্বলটুকুও তুলে দেয়, আশায় থাকে সুদিনের। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়, ভাগ্য আর বদলায় না। এই অংশটি দর্শকদের মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কঠিন বাস্তবতাকে, যেখানে আশার বেলুন ফোলে কিন্তু পেটের ক্ষুধা মেটে না।
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার মুহূর্ত: ফিল্মটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর ক্লাইম্যাক্স বা চরম মুহূর্তটি। দেড় বছর ধরে সংস্কারের একই রেকর্ড বাজানোর পর, গ্রামবাসী যখন ক্লান্ত, তখন সেখানে আবির্ভাব ঘটে এক ‘পণ্ডিত পথিকের’। এই চরিত্রটি গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে এসে গ্রামবাসীকে শেখায় এক নতুন মন্ত্র “এই করে খাবি কয়দিন?”, পথিকের ভাষায় যা “রিয়েলিটি চেক মন্ত্র”। অন্ধের মতো বিশ্বাস না করে প্রশ্ন করতে শেখার এই রূপকটি অসাধারণ। জাদুকর যখন আবারও সেই পুরনো বুলি আউড়াতে শুরু করেন, তখন গ্রামবাসী আর চুপ থাকে না। তারা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে “এই করে খাবি কয়দিন? ওরে বাটপার, এই করে খাবি কয়দিন?”
এই একটি লাইন বা স্লোগান পুরো শর্ট ফিল্মটির সারমর্ম। এটি কেবল একটি সংলাপ নয়, বরং এটি সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যে জাদুকর ভেবেছিলেন তার ‘মাইক্রো-ম্যাজিক’ দিয়ে অনন্তকাল মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাবে, তাকে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয় জনতার এই রূঢ় বাস্তবতার সামনে।
শৈল্পিক উপস্থাপন ও অ্যানিমেশন: “সংস্কার করে যাক না কটা দিন” শর্ট ফিল্মটি কেবল গল্পের জোরেই নয়, এর ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার জন্যও প্রশংসার দাবিদার। কার্টুন বা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সিরিয়াস বিষয়কে কতটা হালকা চালে অথচ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, তার এক অনন্য উদাহরণ এই ফিল্মটি। চরিত্রগুলোর হাঁটাচলা, বিশেষ করে জাদুকরের চশমার আড়ালে ‘কুবুদ্ধির ঝিলিক’ বা ভাঙা টিনের চোঙায় বক্তৃতা দেওয়ার দৃশ্যগুলো দর্শকদের হাসতে বাধ্য করবে, এবং পরমুহূর্তেই ভাবিয়ে তুলবে।
কেন দেখবেন এই শর্ট ফিল্মটি? যারা রাজনৈতিক স্যাটায়ার বা সামাজিক ব্যাঙ্গাত্মক রচনা পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি একটি মাস্ট-ওয়াচ। এটি আপনাকে হাসাবে, কিন্তু সেই হাসির শেষে এক ধরণের তিক্ত সত্যের স্বাদ রেখে যাবে। প্যারিসের বিমান ধরার জন্য জাদুকরের প্রস্থান এবং গ্রামবাসীর হিসাব চাওয়ার দৃশ্যটি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে, জনগণ সব সহ্য করে, কিন্তু দিন শেষে তারা ঠিকই হিসাব মেলাতে জানে।
তাই আর দেরি না করে দেখে নিন এই সময়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং আলোচিত অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম “সংস্কার করে যাক না কটা দিন”। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা ভালো, কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন প্রহসনে পরিণত হয়, তখন নতুন করে জেগে ওঠাই একমাত্র পথ, এই বার্তাই পৌঁছে দেবে “সংস্কার করে যাক না কটা দিন” এনিমেটেড শর্ট ফিল্মটি।