শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও সংস্কারের জাঁতাকলে ইতিহাসের নতুন বয়ান

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও সংস্কারের জাঁতাকলে ইতিহাসের নতুন বয়ান। Martyred Intellectuals Day and the Rewriting of History Under the Guise of Reform. শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও সংস্কারের জাঁতাকলে ইতিহাসের নতুন বয়ান। Martyred Intellectuals Day and the Rewriting of History Under the Guise of Reform.

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর সংস্কারের নামে ধোকা, সবই চলছে সমান তালে। জানুন কীভাবে একাত্তরের ঘাতক আল বদরদের বাঁচাতে তৈরি হচ্ছে ইতিহাসের নতুন ও আজব সব বয়ান।

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: ডিসেম্বর মাস এলেই বাঙালির মনে একটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি কাজ করে, একদিকে বিজয়ের আনন্দ আর অন্যদিকে স্বজন হারানোর তীব্র বেদনা। বিশেষ করে ১৪ই ডিসেম্বর তারিখটা ক্যালেন্ডারের পাতায় ভেসে উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য, যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর, আল শামস আর রাজাকাররা মিলে ঠিক করেছিল, দেশটা স্বাধীন হলেও যেন মেধায় পঙ্গু হয়ে থাকে। তাই তো বেছে বেছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিক্ষকদের চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে রায়েরবাজার আর মিরপুরের বধ্যভূমিতে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারা। কিন্তু হায়, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমরা বোধহয় এক প্যারালাল ইউনিভার্সে বা সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসবাস করছি। কারণ বর্তমানে তথাকথিত ‘নতুন বাংলাদেশে’ ইতিহাসের যে ‘রেনোভেশন’ বা সংস্কার চলছে, তাতে মনে হচ্ছে একাত্তরের সেই ঘাতকরা আসলে ভিলেন ছিল না, তারা ছিল কেবল ভুল বোঝা কিছু সমাজসেবক, আর আসল ভিলেন ছিল মুক্তিযোদ্ধারা, ৩০ লাখ শহিদেরা! আর এসবই হচ্ছে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস মহোদয় এবং তার অন্তর্বর্তী নামের এক জগাখিচুড়ি সরকারের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায়।

একাত্তরের ডিসেম্বরে যখন বাঙালি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন আল বদর আর আল শামস বাহিনী ব্যস্ত ছিল বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার, বাঙালি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। অথচ আজ চুয়ান্ন বছর পর, সেই একই রাজাকার-আলবদরদের আত্মারা যেন নতুন শরীরে ভর করে ‘সংস্কারক’ এর তকমা লাগিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার করিডরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলনামা ঘাটলে দেখা যায়, তারা ‘সংস্কার’ বা রিফর্ম-এর নামে দেশটাকে এমন এক ল্যাবরেটরিতে পরিণত করেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এসিডে চুবিয়ে নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এই ল্যাবরেটরির প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে বসে আছেন স্বয়ং ডক্টর ইউনূস, যিনি একহাতে নোবেল প্রাইজ আর অন্যহাতে ‘রিসেট বাটন’ নিয়ে বসে আছেন। তিনি নাকি অতীত মুছে ফেলে সব নতুন করে শুরু করতে চান। এই ‘রিসেট’ বাটন চাপার ফলে যা হয়েছে তা হলো, একাত্তরের ঘাতকরা এখন আর ঘাতক নয়, তারা এখন ‘মজলুম’ বা নির্যাতিত। আর যারা দেশের জন্য প্রাণ দিল, সেই ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোন যেন ইতিহাসের ফুটনোট বা পাদটীকা হয়ে গেছে।

সবচেয়ে মজার এবং একইসাথে করুণ ব্যপার হলো ১৪ই ডিসেম্বর নিয়ে বর্তমানের নব্য-রাজাকারদের আস্ফালন। বিশ্বের তাবৎ বাঘা বাঘা মিডিয়ার নাকের ডগাতেই পাকিস্তানি আর্মি আর তাদের দোসররা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এই গণহত্যার হাজার হাজার পত্রিকার পাতা আর দলিলে ঠাঁসা প্রমাণ রয়েছে। সারা বিশ্ব জানে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে। নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন সহ সারা বিশ্বের গণমাধ্যম এই সত্যটা দলিল হিসেবে রেখে গেছে। কিন্তু এখনকার ‘সংস্কারমনা’ বুদ্ধিজীবীরা, যারা আবার প্রধান উপদেষ্টার খুব কাছের লোক বলে পরিচিত, তারা নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন। তাদের মতে, একাত্তরে নাকি আল বদররা কাউকে মারে নাই, তারা তো শুধু পাহারাদার ছিল! আর বুদ্ধিজীবীদের মেরেছে নাকি প্রতিবেশী দেশ ভারত! এই কথা শোনার পর রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শায়িত শহীদদের কঙ্কালগুলোও হয়তো লজ্জায় মাটির আরও গভীরে ঢুকে যেতে চাইছে। এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগিতা দেখে মনে হয়, মিথ্যা বলার জন্যও বোধহয় এখন আলাদা নোবেল প্রাইজ চালু করা দরকার।

এই যে ইতিহাসকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা, এর পেছনে কিন্তু একটা গূঢ় রহস্য আছে। বর্তমান অবৈধ সরকার ক্ষমতায় এসেছে একটি ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’ বা সূক্ষ্মভাবে নকশা করা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। ছাত্র-জনতা নামধারী কিছু রাজাকারের নাতিপুতিদের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়েছে। আন্দোলনের সেই দিনগুলিতে এরা সাধারণ মানুষকে ‘ম্যানিপুলেট’ করতে বা আন্দোলনে সামিল করতে মুক্তিযুদ্ধের গান, স্লোগান, এমনকি বঙ্গবন্ধুর উক্তিও দেদারসে ব্যবহার করেছে। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল এই আন্দোলনকারীরা হয়তো স্বাধীনতার স্বপক্ষেরই মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে এদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল জনগণ। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে সাথেই সব কিছু ভোজবাজির মতো উল্টে গেল। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান হয়ে গেল নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু হলো, আর রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরিভাবে দখল করে নিল জামায়াতে ইসলামী, যারা কিনা সেই একাত্তরের নরঘাতক রাজাকার, আল শামস আর আলবদরদের দ্বারা পরিচালিত। প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় মুখে বলেন গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা, কিন্তু তার আশেপাশে তাকালে দেখা যায় একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা নতুন লেবাসে বসে আছে। এরা কেউ কেউ ‘সমন্বয়ক’, কেউবা ‘উপদেষ্টা’, আবার কেউ ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’। এদের কাজ হলো সারাদিন টকশো আর সেমিনারে বসে প্রমাণ করা যে, ১৯৭১ সালে যা যা আমরা শুনেছি, সব ভুল। তাদের মতে, রাজাকাররা ছিল আসলে দেশের ‘রিয়েল হিরো’, যারা নাকি পাকিস্তানকে টিকিয়ে রেখে ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিল। আর এই বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তারা উঠেপড়ে লেগেছে।

মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি যখন ডক্টর ইউনূসের চোখের সামনেই ১৪ই ডিসেম্বরের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করে, তখন তিনি থাকেন মৌনব্রতে। তার এই নীরবতাই প্রমাণ করে যে, ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ’। তিনি হয়তো ভাবছেন, এই রাজাকারদের খুশি রাখতে পারলেই তার গদি ঠিক থাকবে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি যে গদিতে বসেছেন, সেই গদিটা বড্ড নড়বরে। এই যে তিনি একাত্তরের ঘাতকদের পুনর্বাসন করছেন, তাদের হাতে দেশের চাবি তুলে দিচ্ছেন, এটা কি সেই শহীদদের সাথে বেইমানি নয়? এটা কি সেই ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের সাথে তামাশা নয়? কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি তো এখন ব্যস্ত তার বিদেশী বন্ধুদের কাছে দেশের তথাকথিত ‘নতুন স্বাধীনতার’ তুলে ধরতে, যেখানে তিনি দেখাচ্ছেন যে তিনি সবাইকে নিয়ে, এমনকি একাত্তরের ঘাতকদের নিয়েও একটা ‘ইনক্লুসিভ’ সরকার গঠন করেছেন। বাহ্! কী চমৎকার তার ভাবনা!

এই নতুন জামানায় বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করাটাও একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। আগে যেখানে মানুষ শোক আর শ্রদ্ধায় দিনটি পালন করত, এখন সেখানে দেখা যায় একদল লোক ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের হাতে একাত্তরের শহীদদের রক্ত। তারা স্লোগান দিচ্ছে, ভাষণ দিচ্ছে, আর সেই ভাষণে ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝাতে চাইছে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা আসলে ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল। আর আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় সেই সব অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মুচকি হেসে হাত নাড়ছেন। দৃশ্যটা দেখলে মনে হয়, আমরা কোনো ট্র্যাজিক কমেডি বা বিয়োগান্তক কৌতুক সিনেমা দেখছি। সিনেমার নাম ‘আ জার্নি উইথ রাজাকারস’।

জনগণ অবশ্য এখন আর বোকা নয়, তারা সব দেখছে আর মুচকি হাসছে। তারা দেখছে কিভাবে ‘সংস্কার’-এর নামে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি আর ইতিহাসকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো বাদ দিয়ে সেখানে ঢোকানো হচ্ছে রাজাকারদের মহিমান্বিত করার গল্প। নতুন প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা যা জানি সব ‘প্রোপাগান্ডা’। আসল সত্য নাকি এখনকার ইউটিউবার আর ফেসবুকের ‘ভাইরাল’ বক্তারা বলছে। এই ভাইরাল বক্তাদের অনেকেই আবার বর্তমান সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। তারা ক্যামেরার সামনে এসে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা একাত্তরে নিজে উপস্থিত থেকে সব দেখেছে, যদিও তাদের জন্ম হয়তো নব্বইয়ের দশকে।

সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়। ইতিহাস বড় নির্মম। তাকে সাময়িক সময়ের জন্য বিকৃত করা যায়, চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু মুছে ফেলা যায় না। ১৪ই ডিসেম্বর যারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছিল, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আজ যারা তাদের সেই আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে সিংহাসনে বসাচ্ছে, তাদের পরিণতিও খুব একটা ভালো হবে না। ডক্টর ইউনূস আর তার ‘সংস্কার’ বাহিনী যতই চেষ্টা করুক না কেন, একাত্তরের চেতনা বাঙালির ডিএনএতে মিশে আছে। কিছুদিন হয়তো তারা বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবে, কিন্তু দিনশেষে সত্যটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করবেই। ততদিন পর্যন্ত আমরা এই ‘রম্য’ বা তামাশা দেখতে থাকি।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *