
বাংলাদেশের জন্য নতুন ফাঁদ: ড. ইউনূসের উত্তরসূরি খুঁজে পেতেই কি ফ্লোটিলা মিশনে শহিদুল আলম?
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: ভূমধ্যসাগরের নোনা জল আর দেড় দিনের আরামদায়ক হাজতবাসের সৌরভ মেখে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশে স্নান করে নিজভূমে পা রেখেছেন আন্তর্জাতিক-ফুটেজ-খাদক-শিরোমণি, মানবাধিকারের ভ্রাম্যমাণ ঠিকাদার এবং হালের সর্বশ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী জনাব শহিদুল আলম। তার এই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে দেশের প্রচারমাধ্যমগুলোতে যে পরিমাণ শোকরানা মাহফিল এবং প্রশংসার বন্যা বয়ে গেছে, তা দেখে গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষেরাও হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেদের দুঃখ ভুলে গিয়ে ভেবেছেন, “আমাদের নাম ভাঙিয়ে এত বড় তারকা তৈরি হচ্ছে, এ-ও বা কম কীসের!”
তবে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, এই ফ্লোটিলা অভিযান, প্রতীকী ত্রাণ এবং পরিকল্পিত আটক এসব আসলে গাজাবাসীর জন্য ছিল না। এ ছিল এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মহরত মাত্র। সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি ছিল প্রায় দুই দশক পুরনো মদকে একটি চকচকে নতুন বোতলে ভরে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার এক নিখুঁত আয়োজন। আর সেই নতুন বোতলের ব্র্যান্ড নাম শহিদুল আলম।
সংশ্লিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, প্রায় দুই যুগ আগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরীক্ষাগারে এক ‘ক্ষুদ্রঋণের মহাজানকে’ নোবেল নামক মহামূল্যবান ফ্লেভার মাখিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই পুরনো মদ যে এতদিনে বেশ জমে উঠেছে এবং তার আসল রং দেখাতে শুরু করেছে, তা আজ আর কারো অজানা নয়। দেশের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে প্রভুদের মনোরঞ্জন করতে করতে সেই মদের ঝাঁজ এখন কিছুটা কমে আসার আশঙ্কা করছেন এর কারিগররা। কারণ, একটি বোতল আর কত দিন চলে! তাই দূরদর্শী প্রভুরা ২০৪৫ সালের বাজার ধরার জন্য এখন থেকেই একজন নতুন ‘সেবক’ তৈরির প্রকল্পে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। সেই প্রকল্পেরই পাইলট প্রজেক্ট ছিল এই ‘মিশন ফ্লোটিলাতে শহিদুল আলমকে পাঠানো’।
এই প্রকল্পের চিত্রনাট্য ছিল একেবারে অস্কারজয়ী। জাহাজে চড়ার পর থেকেই দেশের অনুগত গণমাধ্যমগুলো যেভাবে ‘শহিদুল এখন কী করছেন?’, ‘শহিদুল ভাইয়ের জাহাজের গতিবেগ কত?’, ‘শহিদুলের সকালের নাস্তায় কী ছিল?’ এইসব নিয়ে লাইভ আপডেট দিচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়েও শহিদুলের জাহাজের নটিক্যাল মাইল গোনা অনেক বেশি জরুরি। গাজার হতভাগ্য শিশুদের নিয়ে দুই লাইন লেখার পরেই ২০ লাইন ধরে শহিদুলের বীরত্বগাথা কীর্তন করা হচ্ছিল। এই নিখুঁত ‘পেইড প্রোমোশন’ দেখে বিজ্ঞাপন জগতের মোড়লেরাও লজ্জা পেয়ে যাওয়ার কথা।
আর এই নাটকের সবচেয়ে মুখরোচক অংশ ছিল ‘প্রতীকী ত্রাণ’। আহা, কী একটি শব্দমালা! ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, বোমায় ছিন্নভিন্ন হওয়া একদল মানুষকে প্রতীকী খাবার দেওয়ার চেয়ে বড় রসিকতা আর কী হতে পারে? এর মাধ্যমে আয়োজকরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাদের আসল উদ্দেশ্য ত্রাণ পৌঁছানো নয়, বরং নিজেদের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বাড়ানো। এই প্রতীকী ত্রাণের চূড়ান্ত পরিণতি হলো প্রতীকী আটক, প্রতীকী জেল খাটা এবং সবশেষে একজন পোড় খাওয়া বিপ্লবী হিসেবে প্রতীকী অভিষেক।
এই অভিষেকের পালায় ধুয়া ধরেছেন খোদ দেশের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর আমির পর্যন্ত। একজন আলোকচিত্রীর জন্য তাদের এই অভূতপূর্ব দরদ দেখে দেশবাসী যারপরনাই আপ্লুত। তাদের এই সম্মিলিত উদ্যোগ প্রমাণ করে, ভবিষ্যতের এই নতুন অবতারকে সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার একটি সুপরিকল্পিত মহড়া চলছে। ঠিক যেভাবে ড. ইউনূসকে বাজারজাত করার সময় সব ধরনের ‘টেস্টার’দের দিয়ে তার গুণগান করানো হয়েছিল।
সুতরাং, যা দেখছেন তা কেবল একজন আলোকচিত্রীর ঘরে ফেরা নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের বীজ বপন। ড. ইউনূসকে দিয়ে আমেরিকার স্বার্থ হাসিলের যে খেলা ২০২৪ সালে সফলতার মুখ দেখেছে, সেই খেলারই একজন নতুন খেলোয়াড়কে আগামী ২০ বছরের জন্য প্রস্তুত করা হলো। এই ‘ফ্লোটিলা-ফেরত বীর’কে আজ যে ক্যামেরার ক্লিকে বন্দি করা হচ্ছে, সেই ক্লিকই হয়তো একদিন দেশের ক্ষমতার মসনদের ক্লিকে পরিণত হবে। দেশের সাধারণ মানুষ যখন এই ‘নতুন বোতলের মদ’ পান করে এর আসল ঝাঁজ টের পাবে, ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। আপাতত, ভাবি অবতারের অভিষেক পর্ব চলুক, আমরা পপকর্ন নিয়ে দেখতে থাকি।