নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: গত বছরের ৫ আগস্টের পর হইতে দেশে যে ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ভাস্কর্য ভাঙচুরের উৎসব চলিতেছে, তাহাকে ভাঙচুর বলিতে নারাজ সদ্য ক্ষমতা দখলকারী নব্য রাজাকারদের ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার সেলের’ স্বঘোষিত মহাপরিচালক, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার পতিদেব, এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা আল্লামা বউ ব্যবসায়ী হুজুরে কেবলা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা ভুল বলিতেছেন। ইহাকে ভাঙচুর বলা যাইবে না, বলিতে হইবে ‘সাংস্কৃতিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান’। আর যাহারা এর বিপক্ষে বিবৃতি দিয়াছেন, তাহারা আসলে ‘ভারতপ্রেমী’। তাহারা পাকিস্তানের ভালো চাহেন না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন—ইহারা সবাই ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক। আর এই ভারতীয় সংস্কৃতির কারণেই তো আমরা একাত্তরে পাকিস্তানের মতো পবিত্র একটি দেশ হইতে আলাদা হইয়া গেলাম। ইহা তো ঐতিহাসিক ভুল! আমরা এখন সেই ভুল সংশোধন করিতেছি মাত্র।”
এদিকে, এই ‘ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন’ কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী সংগঠন ‘একাত্তরের পরাজয় প্রতিশোধ বাস্তবায়ন কমিটি’-র সভাপতি ও বিশিষ্ট রাজাকারবংশীয় চিন্তাবিদ জিন্নাহপ্রেমী সাদিক চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার দাদা একাত্তরে অল্পের জন্য মিশন শেষ করিতে পারেন নাই। দাদার সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করিবার জন্যই আমাদের এই সংগ্রাম। এই দেশের মাটি হইতে সকল প্রকার ভাস্কর্য, গান-বাজনা, মেলা ও উৎসবের চিহ্ন মুছিয়া দিয়া আমরা এখানে একটি আদর্শ মিনি-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিব। দেশের নাম বদলাইয়া ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখার প্রস্তাবও আমরা সরকারের কাছে দিয়াছি।”
দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইত্যাদি ধ্বংস করার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তেজিত হইয়া বলেন, “ঐগুলো তো আসল ইতিহাস ধ্বংস করিয়া বানানো হইয়াছিল। আমরা তো শুধু আসল ইতিহাস পুনরুদ্ধার করিতেছি। ঐসব স্থাপনার জায়গায় আমরা শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের স্মরণে বহুতল ‘শান্তি ভবন’ নির্মাণ করিব।”
তবে এই ‘সাংস্কৃতিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ যে সকলে ভালোভাবে লইতেছে না, তাহার প্রমাণও মিলিতেছে। দেশের প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিরা এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন। এ বিষয়ে কথা হয় একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো বীর অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের সহিত। তিনি তাঁহার পুরানো মরচে পড়া বন্দুকটি পরিষ্কার করিতে করিতে বলেন, “আমার এই হাতিয়ার এখনো অকেজো হইয়া যায় নাই। একাত্তরে পাকিস্তানিগো খেদাইছি, আর এখন এইগুলান নাতি-পুতি রাজাকার তো নস্যি! শেখ মুজিবের জন্ম দেওয়া বাংলাদেশটা কারো বাপের বাড়ির আবদার না যে যখন তখন নাম-নিশানা বদলাইয়া দিবে।”
এদিকে, সরকারের পক্ষ হইতে ভাঙচুর প্রতিরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না লইয়া বরং একটি নতুন কমিটি গঠন করা হইয়াছে। ‘ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বাছাই কমিটি’ নামক এই কমিটির কাজ হইবে দেশের কোন কোন স্থাপনা ও ভাস্কর্য ‘ইসলাম ও পাকিস্তানি চেতনার সহিত সাংঘর্ষিক’ তাহা চিহ্নিত করা। মজার বিষয় হইল, এই কমিটির সকল সদস্যই ‘একাত্তরের পরাজয় প্রতিশোধ বাস্তবায়ন কমিটি’ হইতে নিয়োগপ্রাপ্ত।
সচেতন মহল মনে করিতেছে, পাকিস্তানি ভাবধারার এই বীজ বাংলার মাটিতে অঙ্কুরিত হইবার চেষ্টা করিলেও তাহা সফল হইবে না। কারণ এই মাটি রক্ত দিয়া কেনা, হাতুড়ি দিয়া দখল করা যাবে না। একাত্তরের পরাজিত শক্তি প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হইয়া ভাস্কর্য ভাঙিতে পারে, বইমেলা পণ্ড করিতে পারে, কিন্তু কোটি বাঙালির হৃদয় হইতে একাত্তরের চেতনা মুছে ফেলার সামর্থ তাহাদের কোনোদিনই হইবে না। বাংলার আকাশে-বাতাসে এখনো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শোনা যায়, যাহা শুনিলে রাজাকারদের নাতিপুতিদের গায়ে জ্বর আসে বলিয়া জানা গিয়াছে। অতিসত্বর তাহাদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হইতে বিশেষ চুলকানির মলম সরবরাহ করা হইবে বলিয়াও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করিয়াছে।