বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ কাফির ফতোয়া রাবির সহযোগী অধ্যাপকের

বেগম রোকেয়াকে ‘মুরতাদ কাফির’ ফতোয়া রাবির সহযোগী অধ্যাপকের। RU Associate Professor Issues ‘Murtad Kafir’ Fatwa Against Begum Rokeya. বেগম রোকেয়াকে ‘মুরতাদ কাফির’ ফতোয়া রাবির সহযোগী অধ্যাপকের। RU Associate Professor Issues ‘Murtad Kafir’ Fatwa Against Begum Rokeya.

৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে পদাৰ্থবিজ্ঞানের নতুন সূত্র। বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ কাফির ফতোয়া দিলেন সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। আমরা কি মধ্যযুগে ফিরছি?

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: আইজ্যাক নিউটন আপেল পড়তে দেখে মধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। আর্কিমিডিস গোসলখানায় ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার দিয়েছিলেন। আর আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্রান্তদর্শী পদাৰ্থবিজ্ঞানী ল্যাবে বসে যা আবিষ্কার করলেন, তা শুনে আইনস্টাইন বেঁচে থাকলে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা টেলিস্কোপ নয়, এই মহান বিজ্ঞানী সম্পূর্ণ খালি চোখে এবং ‘সহিহ’ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মেপে ফেলেছেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার ঈমানের ঘনত্ব। ফলাফল? বেগম রোকেয়া নাকি ‘মুরতাদ’ এবং ‘কাফির’

পদাৰ্থবিজ্ঞানের ল্যাবে যে আজকাল থার্মোমিটারের বদলে ‘ঈমানোমিটার’ নিয়ে গবেষণা হয়, তা এই ঘটনার আগে জাতি জানত না। এই সহযোগী অধ্যাপক প্রমাণ করে দিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের চেয়েও জটিল হলো নারীর স্বাধীনতা। ইলেকট্রন-প্রোটন যেমন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তেমনই এই বঙ্গে নারীরা রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর কেন্দ্র করে ঘুরবে, এটাই তো প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম হওয়ার কথা ছিল! রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামের এক ভদ্রমহিলা এসে সেই প্রাকৃতিক নিয়মে ফাটল ধরিয়েছিলেন। তাই শত বছর পর তাকে ‘কাফির’ ট্যাগ দিয়ে ল্যাবরেটরি থেকে এক বিশাল বৈজ্ঞানিক প্রতিশোধ নেওয়া হলো।

এই ‘মৌলবাদী’ গবেষণার টাইমিংটা লক্ষ্য করার মতো। দেশে এখন এক অদ্ভুত ‘স্বাধীনতার’ বাতাস বইছে। ৫ আগস্টের পর থেকে মনে হচ্ছে, বোতলের ছিপি খুলে গেছে আর ভেতর থেকে সকল প্রকার ধর্মান্ধ শয়তান বেরিয়ে এসে হালুম-হুলুম করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যাদের নেতৃত্বে আছেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস, তারা যেন এই শয়তানদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করে দিয়েছেন। স্বৈরাচার দমনের নামে আমরা এমন এক জমানায় প্রবেশ করেছি, যেখানে বিজ্ঞানমনস্কতা হলো অপরাধ আর কুসংস্কার হলো মেধার পরিচয়। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো ভাবছেন, এসব ছোটখাটো ‘ফতোয়া’ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই, তারা রাষ্ট্র সংস্কারে ব্যস্ত। অথচ রাষ্ট্রের মনন যে পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই।

আমাদের সেই মহান শিক্ষক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান হয়তো ক্লাসে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে আলোর বিচ্ছুরণ পড়ান। কিন্তু তার নিজের মগজের প্রিজম দিয়ে কেবল অন্ধকারের সাতটি রং বের হয়। তার যুক্তি খুব সরল, রোকেয়া নারীদের ঘরের বাইরে এনেছেন, বই ধরিয়েছেন, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন। আর প্রশ্ন করলেই তো বিপদ! নারী যদি প্রশ্ন করে, তবে ‘পুরুষের’র খবরদারি চলে না। সকালবেলা গরম ভাতের সাথে ভর্তা আর রাতে পায়ের সেবা, এই যে সলিড স্টেট ফিজিক্সের মতো অটুট পারিবারিক বন্ধন, এটা তো রোকেয়ার কারণেই ঢিলা হয়ে গেছে। তাই রোকেয়াকে খারিজ করা মানে হলো পুরুষতন্ত্রের পুরনো সেই জমিদারী ব্যবস্থাকে ‘রিস্টোর’ করা।

ফেসবুক নামক ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমে এই ফতোয়ার পক্ষে যারা তালি দিচ্ছেন, তাদের প্রোফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে, তারা আধুনিক সব গ্যাজেট ব্যবহার করেন কিন্তু চিন্তায় ঘোরেন উটের পিঠে চড়ে। তাদের কাছে রোকেয়া হলেন সেই ভিলেন, যিনি তাদের ‘চার বিয়ে’ এবং ‘বউ পিটানোর’ পবিত্র অধিকার হরণ করেছেন। এই ভক্তকূল মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো ইসলামি ফতোয়া দেওয়া আর হুজুরের কাজ হলো সমাজ চালানো। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেই হুজুরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন সোনায় সোহাগা। তখন আর ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করার দরকার হয় না, ফতোয়া দিলেই পিএইচডি হয়ে যায়।

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো রাষ্ট্রের নীরব সম্মতি। যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেশের অগ্রদূতকে অপমান করেন, এবং তার কিছুই হয় না, তখন বুঝে নিতে হয় আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি। বর্তমান শাসনামলে ভাস্কর্য ভাঙা থেকে শুরু করে পাঠ্যবই ছিঁড়ে ফেলা, সবই জায়েজ। কারণ এখন ‘সেন্টিমেন্ট’ খুব স্পর্শকাতর। রোকেয়াকে সম্মান দেখালে যদি কারো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত লাগে, তবে সরকার বাহাদুর রোকেয়াকেই বলি দিতে প্রস্তুত।

বেগম রোকেয়া কবরে শুয়ে হয়তো এসব দেখে মুচকি হাসছেন। তিনি জানতেন, আগাছা উপড়ে ফেললেও তার শিকড় অনেক গভীরে থাকে। তিনি লিখেছিলেন ‘সুলতানার স্বপ্ন‘, আর আমাদের এই নতুন দিনের পদাৰ্থবিজ্ঞানীরা আমাদের দেখাচ্ছেন ‘তালিবানের স্বপ্ন‘। তবে তারা ভুলে গেছেন, রোকেয়া কোনো ব্যক্তি নন, তিনি এক চেতনা। তাকে ‘কাফির’ বলে গালি দিলে তার কিছু যায় আসে না, কিন্তু এতে প্রমাণ হয় যে, আমাদের শিক্ষার মেরুদণ্ডটি ভেঙে এখন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ল্যাবরেটরি থেকে এখন আর বিজ্ঞানের আলো আসবে না, আসবে কেবল মধ্যযুগের অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে বসে আমরা হয়তো শীঘ্রই গবেষণা করব ‘পৃথিবী সমতল’ নাকি ‘নারীর মগজ ছোট’।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *