গ্রেনেড হাতে শান্তির দূত এবং একজন ফাতেমার প্রস্থান: সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে শিক্ষিকার মৃত্যু
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: দুনিয়াতে কত রকমের শান্তি আছে, তার ইয়ত্তা নেই। কেউ শান্তি পায় নোবেল পুরস্কারে, কেউ শান্তি পায় সুদের ব্যবসায়, আর আমাদের মহান, ‘অবৈধ’ ও ‘জবাবদিহিহীন’ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তি খুঁজে পেয়েছেন সাউন্ড গ্রেনেডের মধুর ঝনঝনানিতে। সেই ঝনঝনানির ডেসিবল এতটাই বেশি ছিল যে, তা ভেদ করে চলে গেছে একজন নিরীহ প্রাথমিক শিক্ষকের হৃৎপিণ্ড, আর উপহার দিয়েছে অনন্তের নিস্তব্ধতা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার কারিগর, সহকারী শিক্ষক ফাতেমা আক্তার (৪৫) এখন আর দশম গ্রেডের দাবি নিয়ে রাজপথে স্লোগান দেবেন না। তিনি এখন চলে গেছেন এমন এক গ্রেডে, যেখানে কোনো বৈষম্য নেই, নেই কোনো সাউন্ড গ্রেনেড, আর নেই কোনো অবৈধ সরকারের রক্তচক্ষু।
গত রোববার সকালে ঢাকার মিরপুরের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফাতেমা আক্তার। আহত হওয়ার ঠিক দশ দিন পর। এই দশ দিন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন, ঠিক যেমনটা তিনি লড়েছিলেন শাহবাগে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড আর জলকামান উপেক্ষা করে। কিন্তু হায়! নোবেল লরিয়েট সরকারের ‘শান্তির গ্রেনেড’ কি আর বিফলে যেতে পারে? ৮ নভেম্বর শাহবাগে শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যখন গ্রেনেড ফাটল, তখন হয়তো ফাতেমা আক্তার বুঝতে পারেননি যে, এই শব্দ আসলে তাঁর জীবনের শেষ সাইরেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, একজন নোবেলজয়ী শাসকের আমলে অন্তত শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা হবে না। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, এই সরকার বৈধতার তোয়াক্কা করে না, জবাবদিহিতার ধার ধারে না। এদের একমাত্র লক্ষ্য গদি টিকিয়ে রাখা, তা সে যত লাশের উপর দিয়েই হোক না কেন।
ফাতেমা আক্তার চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ঝিনাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি দুই সন্তানের মা। আজ সেই দুই সন্তান এতিম। তাদের মা আর কখনো ক্লাসে ফিরবেন না, কখনো আর ব্লাকবোর্ডে চক ঘষবেন না। তাদের মা এখন মাটির নিচে। আর মাটির ওপরে বসে আছেন আমাদের ‘সুশীল’ উপদেষ্টারা, যারা এই মৃত্যুকেও জাস্টিফাই করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার তো দিব্যি বলে দিলেন, এই মৃত্যুর দায় নাকি শিক্ষক নেতাদের! বাহ্! কী চমৎকার লজিক! সাউন্ড গ্রেনেড মারল পুলিশ, হুকুম দিল সরকার, আর দোষ হলো নেতাদের? মানে, আমি যদি আপনাকে লাঠি দিয়ে পেটাই, আর আপনি যদি ব্যথায় কোঁকান, তাহলে দোষ আপনার, কেন আপনি লাঠির সামনে আসলেন? এই হলো আমাদের তথাকথিত ‘বিপ্লবী’ সরকারের ন্যায়বিচারের নমুনা।
উপদেষ্টা মহোদয় আরও বলেছেন, শিক্ষকদের আন্দোলন নাকি ‘অযৌক্তিক’। হ্যাঁ, তা তো হবেই। দেড় বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা যৌক্তিক, শেয়ারবাজার লুট করা যৌক্তিক, কিন্তু শিক্ষকরা পেটে ভাতের অভাবে একটু সম্মানজনক বেতনের দাবি করলেই তা হয়ে যায় অযৌক্তিক। কারণ, শিক্ষকরা তো আর গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি আদায়কারী নন, তারা তো আর বিদেশি প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী নন। তারা কেবল মানুষ গড়ার কারিগর।
শাহবাগে সেদিন যা ঘটেছিল, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত বার্তা। বার্তাটি হলো, চুপ থাকো, নতুবা মরো। ড. ইউনূস ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝিয়ে দিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান, আর আইসিইউর টিকেট। ফাতেমা আক্তার সেই বার্তারই বলি হলেন। তিনি চেয়েছিলেন সম্মান, পেলেন মৃত্যু। তিনি চেয়েছিলেন দশম গ্রেড, পেলেন কবরের মাটি। আর আমরা, সাধারণ জনতা, চেয়ে চেয়ে দেখলাম কীভাবে একটি অবৈধ সরকার তার ক্ষমতার দম্ভে একজন শিক্ষকের প্রাণ কেড়ে নিল।
এই যে সাউন্ড গ্রেনেড, এটা কিন্তু সাধারণ কোনো শব্দবোমা নয়। এটা হলো ‘সংস্কারের শব্দ’। যখনই কেউ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামে, তখনই এই ‘সংস্কার’ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। আর সেই বিস্ফোরণে কার হার্ট অ্যাটাক হলো, কার কান ফাটল, কার জীবন গেল, তাতে এই সরকারের কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, তাদের তো কোনো ম্যান্ডেট নেই। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে না হয় জবাবদিহিতার ভয় থাকত। কিন্তু যারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছে জনগণের জীবনের মূল্য কচুপাতার পানির চেয়েও কম।
এখন প্রশ্ন হলো, সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে শিক্ষিকার মৃত্যুর দায় কে নেবে? উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার তো আগেই হাত ধুয়ে ফেলেছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, মৃত মানুষের তো আর বিচার চাওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন, এই দেশের মানুষ সব মনে রাখে। ফাতেমা আক্তারের এই মৃত্যু কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি এই স্বৈরাচারী আচরণের এক জ্বলন্ত দলিল। ড. ইউনূস হয়তো ভাবছেন, বিদেশি বন্ধুদের সার্টিফিকেট দেখিয়ে পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু দেশের মানুষের আদালতের রায় কোনো বিদেশি সার্টিফিকেটে বদলায় না।
ফাতেমা আক্তারের জানাজায় যখন তাঁর সহকর্মী, শিক্ষার্থী আর স্বজনেরা চোখের পানি ফেলছিলেন, তখন হয়তো ঢাকার কোনো এক এসি রুমে বসে উপদেষ্টারা নতুন কোনো ‘রিফর্ম’ বা সংস্কারের ছক কষছিলেন। তাদের সেই সংস্কারে সাউন্ড গ্রেনেডের বাজেট বাড়বে, পুলিশের লাঠির মান উন্নত হবে, কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। কারণ, শিক্ষকদের পেটে লাথি মারাটাই এখন এই সরকারের ‘উন্নয়ন’ দর্শন।
এই সরকার যে কতটা দেউলিয়া, তা তাদের কথা ও কাজেই প্রমাণ। একদিকে তারা বলছে, ফাতেমা আক্তারের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে, অন্যদিকে বলছে আন্দোলনটা ছিল অযৌক্তিক। মানে, মারবও আমি, আবার মলমও লাগাব আমি, কিন্তু কান্নাকাটি করতে পারবে না। এই দ্বিমুখী নীতিই হলো ড. ইউনূসের শাসনমালের ট্রেডমার্ক। তিনি মুখে বলেন শান্তির কথা, আর কাজে করেন অশান্তির চাষ। তিনি মুখে বলেন মানবাধিকারের কথা, আর বাস্তবে হরণ করেন মানুষের বাঁচার অধিকার।
ফাতেমা আক্তারের স্বামী ডি এম সোলেমান এখন দুই সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে। তাঁর স্ত্রীর অপরাধ ছিল, তিনি চেয়েছিলেন একটু ভালো থাকতে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন। আর তার বিনিময়ে তিনি পেলেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস কি কেবল ফাতেমা আক্তারের ওপর হয়েছে? না, এই সাউন্ড গ্রেনেড প্রতিটি শিক্ষকের বুকে বিঁধেছে। এই মৃত্যু প্রতিটি বিবেকবান মানুষের গালে চপোটাঘাত করেছে।
আমরা জানি, এই সরকার এই মৃত্যুর কোনো সঠিক তদন্ত করবে না। তারা হয়তো একটি তদন্ত কমিটি করবে, সেই কমিটি রিপোর্ট দেবে যে, ফাতেমা আক্তার আসলে হার্ট অ্যাটাক করেই মারা গেছেন, সাউন্ড গ্রেনেডের কোনো দোষ নেই। সাউন্ড গ্রেনেড তো খুব ইনোসেন্ট জিনিস, সে তো কেবল শব্দই করে! কিন্তু আমজনতা, বোকা নয়। আমজনতা জানে, এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। এবং এই হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা হিসেবে ড. ইউনূসকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।
আজ যারা ক্ষমতার দম্ভে মাটিতে পা ফেলছেন না, তারা মনে রাখবেন, দিন বদলায়। ফাতেমা আক্তারের আত্মা আপনাদের ক্ষমা করবে না। তাঁর এতিম দুই সন্তানের চোখের পানি আপনাদের গদি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে সাময়িক ভয় দেখানো যায়, কিন্তু মানুষের ভেতরের ক্ষোভ নেভানো যায় না। সেই ক্ষোভের আগুন যখন জ্বলবে, তখন কোনো পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না মাননীয় ‘অবৈধ’ প্রধান উপদেষ্টা।
সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে ফাতেমা আক্তার মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর দাবি মরে যায়নি। তাঁর সহকর্মীরা এখনো বেঁচে আছেন। তাঁরা দেখছেন, তাঁরা শিখছেন। তাঁরা মনে রাখছেন প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি অপমান। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ হয়তো বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু সেই শব্দের রেশ ধরে যে বিপ্লবের জন্ম হবে, তা থামানোর সাধ্য কোনো ‘নোবেল’ বা ‘গ্রেনেড’ এর নেই। ফাতেমা আক্তার, আপনি শান্তিতে ঘুমান। আপনার অসমাপ্ত লড়াই লড়বে এদেশের মানুষ। আর যারা আপনার এই অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের বিচার হবেই। জনতার আদালতে তাদের কোনো রেহাই নেই।
বিদায় ফাতেমা আক্তার। আপনার রক্ত বৃথা যাবে না। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে যে রাষ্ট্র কেঁপে ওঠে না, বরং একজন শিক্ষকের মৃত্যুতে যে রাষ্ট্র উল্লাস করে বা উদাসীন থাকে, সেই রাষ্ট্রকে মেরামত করতেই হবে। আর সেই মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ড. ইউনূস, প্রস্তুত তো? পালানোর পথ কিন্তু খোলা নেই!