৮৫ শতাংশ শান্তির দেশে বাকি ১৫ শতাংশের আতঙ্কিত হওয়ার তীব্র নিন্দা। The Intense Condemnation of the 15 Percent Who Feel Scared in a Country of 85 Percent Peace৮৫ শতাংশ শান্তির দেশে বাকি ১৫ শতাংশের আতঙ্কিত হওয়ার তীব্র নিন্দা। The Intense Condemnation of the 15 Percent Who Feel Scared in a Country of 85 Percent Peace

নিজস্ব প্রতিবেদক: শান্তিতে নোবেল জয় করিয়া ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে জনজীবনে অভূতপূর্ব শান্তি আনয়নকারী, কিস্তির মাহাত্ম্য প্রচারক, অন্তর্বর্তীকালীন মসনদের প্রধান উপদেষ্টা, ডক্টর ইউনূস সরকারের যুগান্তকারী জরিপের ফলাফল প্রকাশের পর দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বইয়া যাইতেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের ফলাফল তুলিয়া ধরা হইয়াছে, যেখানে বলা হইয়াছে দেশের ৮৫ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করিতে সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করেন।

এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছিলেন পরিকল্পনা জগতের ব্যাটম্যান, অর্থনীতির এনালগ ক্যালকুলেটর, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি তাহার ভাষণে বলিলেন, “এই জরিপ প্রমাণ করে যে, দেশে এখন শান্তি আর শান্তি। মানুষ নির্ভয়ে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। অর্থনীতিও এই শান্তির ফলে দ্রুত আগায়া যাইবে। ছিনতাই-ডাকাতি কমিয়া যাওয়ায় মানুষের হাতে টাকা-পয়সা থাকিতেছে, যাহা দিয়া তাহারা সময়মতো আমাদের ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধ করিতে পারিবে।”

জরিপের তথ্য যখন তুলিয়া ধরিতেছিলেন জরিপের প্রকল্প পরিচালক আল্লামা রাশেদ-ই-মাসতাহাব, তখন তাহার চোখেমুখে তৃপ্তির আভা দেখা যাইতেছিল। তিনি বলিলেন, “আমরা দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরিয়া এই তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি। কিছু কিছু এলাকায় আমাদের জরিপকারী দলকে ছিনতাইকারীরা ধরিয়াছিল বটে, কিন্তু পরে যখন তাহারা জানিতে পারে আমরা ইউনূস সরকারের শান্তির জরিপ করিতে আসিয়াছি, তখন তাহারা আমাদিগকে শুধু ছাড়িয়াই দেয় নাই, উল্টো রাতের বেলা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য এসকর্টও দিয়াছে। ইহাতেই বুঝা যায়, দেশের মানুষ কতটা নিরাপদে আছে।”

কিন্তু এই আনন্দের সংবাদ প্রকাশের পরপরই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক অন্ধকার গলিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তীব্র ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করিয়াছে ‘শান্তির চোদনে ভুক্তভোগী নাগরিক ইউনিয়ন’। এইসময় ইউনিয়নের সভাপতি, দিনে-দুপুরে ঘরের মধ্যে থেকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা, গত তিন মাসে দুইবার মোবাইল ও একবার মানিব্যাগ হারানো, ‘হাঁটলেই বিপদ’ শীর্ষক আন্দোলনের আহ্বায়ক আলমগীর মুক্তাদির কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।

হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া আলমগীর মুক্তাদির বলিলেন, “৮৫ শতাংশ মানুষ যদি নিরাপদই বোধ করে, তাইলে আমার বাসার সামনের রাস্তায় যে কাল রাতে এক লোককে চাপাতি দিয়া কুপাইয়া মোটরসাইকেল নিয়া গেল, সে কি ভিনগ্রহের বাসিন্দা ছিল? আমার শালার ছোট ভাইয়ের একমাত্র বড় বোনের জামাইয়ের মোবাইলটা যে টান মারিয়া নিয়া নিল, সেও কি ওই ৮৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল? এই জরিপ কি সুইডেনে করা হইয়াছে নাকি সুইজারল্যান্ডে? নাকি যাহারা জরিপ করিতে গিয়াছিল, তাহাদের মাথায় বন্দুক ঠেকাইয়া ছিনতাইকারীরাই এইসব তথ্য লিখিতে বাধ্য করিতেছে?”

তিনি আরও বলিলেন, “সরকার বলিতেছে মানুষ নিরাপদে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হইল, আমরা এখন বাথরুমে গেলেও দরজার ছিটকিনি দশবার চেক করি। সন্ধ্যার পর এলাকায় বাহির হওয়া তো দূরের কথা, দিনের বেলায় ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে গেলেও চারদিকে তাকাইয়া দেখি কেহ রামদা হাতে দাঁড়াইয়া আছে কি না। আমার পরিচিত এক বড় ভাই ব্যাংক হইতে ঋণের টাকা তুলিয়া রিকশায় করিয়া বাড়ি ফিরিতেছিলেন। পথিমধ্যে কয়েকজন আসিয়া নিজেদের ‘যৌথ বাহিনী’ পরিচয় দিয়া সব টাকা নিয়া গেল। পরে জানা গেল, তাহারা আসলে ‘চৌর্য বাহিনী’। এই যদি হয় দেশের অবস্থা, তাইলে ৮৫ শতাংশ মানুষ কারা যাহারা সন্ধ্যার পর একা চলাফেরা করিতে পারে? তাহারা কি সবাই পুলিশ লাইনে বা সেনানিবাসে বসবাস করে?”

এই সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলিলেন, “আমি নিজে একজন ছিনতাইকারীর কবলে পড়িয়াছিলাম। সে আমার সবকিছু কাড়িয়া নেওয়ার পর আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ভাই, আপনারা এত কষ্ট করিয়া ছিনতাই করেন, সরকার তো বলে দেশে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছে।’ উত্তরে সে হাসিয়া বলিল, ‘আরে মিয়া, সরকার তো আমাদের পার্টনার। আমরা যদি কাজ না করি, তাইলে তাহারা নতুন নতুন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা কীভাবে পাইবে? এইসব না করিলে আমাদের আর স্যারদের ব্যবসা চলিবে কীভাবে?'”

এদিকে, এই জরিপের ফলাফলে শুধু ভুক্তভোগীরাই নন, পেশাদার অপরাধীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন। ‘বাংলাদেশ ছিনতাইকারী ও ডাকাত সমিতির (বাসডাস)’-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহাসচিব এক গোপন বিবৃতিতে বলিলেন, “এই জরিপ আমাদের কঠোর পরিশ্রম এবং পেশাদারিত্বের প্রতি এক চরম অপমান। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করিয়া মানুষের মনে ভয়-ভীতি ঢুকাইয়া রাস্তাঘাটে ভীড়-গ্যাঞ্জাম-জ্যাম কমাইলাম। আগে যে ঢাকা শহর ২৪ ঘন্টাই জাগিয়া থাকিত, সেই তিলোত্তমা ঢাকাকে আমরা সন্ধ্যার পর পরই বিছানায় পাঠাইয়া দিলাম। শহরে শান্তি নিয়া আসিলাম, কিন্তু আমাদের কোনো ক্রেডিট ইউনূস সরকারের পরিসংখ্যানে দেখিতে পাইলাম না! ইহা আমাদের পেশার উপর, আমাদের ডেডিকেশনের উপর সরাসরি আঘাত। আমরা ইহার তীব্র নিন্দা জানাই। এই ক্রেডিট চুরির কারণে আমাদের সদস্যরা হতাশায় ভুগিতেছে। অনেকে পেশা পরিবর্তনের কথাও ভাবিতেছে।”

তিনি হুংকার দিয়া বলিলেন, “আমরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়া বলিতে চাই, আপনারা আমাদের সাথে নিয়া একটি যৌথ জরিপ করুন। আমরা গ্যারান্টি দিতেছি, ১০০ শতাংশ মানুষ বলিবে তাহারা নিরাপদ। আমরা প্রমাণ করিয়া ছাড়িব, দেশে আসলে শতভাগ নিরাপদ পরিস্থিতি বিরাজ করিতেছে। আমাদের দাবি না মানা হইলে আমরা যমুনা ঘেরাও এর মতো কর্মসূচি দিতে বাধ্য হইব।”

জরিপের ফলাফল নিয়া কথা বলিতে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, রাত তিনটায় সংবাদ সম্মেলন করিয়া সাহসিকতার পরিচয় দেওয়া, নিজের কুশপুত্তলিকা দাহকে স্বাভাবিক ঘটনা মনে করা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলিলেন, “দেখুন, ছোটখাটো ঘটনা আগেও ঘটিত, এখনো ঘটিতেছে। গত ১৬ বছর খুব ডাকাতি চুরি হইলেও তখন ঘটনা জানিতে দুই চার দিন লাগিত, এখন আমরা স্টারলিংক নিয়া আসায় সাথে সাথে এইসব জানা যায়। এই জন্য মনে হইতেছে ১৫% মানুষ নিরাপদ বোধ করিতেছে না। আসলে পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে উন্নতির অবকাশ আছে। আর আমরা জরিপের ফলাফল এডিট করিয়া দিব, তখন ১০০% নিরাপদ দেশ হইবে বাংলাদেশ।”

উপস্থিত সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করিলেন, “স্যার, ৮৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ থাকিলে তো আপনাদের রাতে কাজ করারই দরকার হয় না,” তখন তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, “আমরা ওই বাকি ১৫ শতাংশের নিরাপত্তার জন্য কাজ করিতেছি। আমাদের লক্ষ্য শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আপনারা আজ রাত হইতেই দেখিবেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে।”

কিন্তু তাহার এই বক্তব্যের পরপরই টঙ্গীতে গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু এবং পুলিশের উপস্থিতিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে তার উত্তরার বাসা হইতে ধরিয়ে নিয়া গলায় জুতার মালা পড়াইয়া ভিডিও করার ঘটনা ঘটে, যাহা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেও নিজেদের নিরাপদ ভাবিতে পারিতেছে না।

এদিকে ‘শান্তির চোদনে ভুক্তভোগী নাগরিক ইউনিয়ন’ এর সভাপতি আলমগীর মুক্তাদির, সরকারের প্রতি একটি প্রস্তাব রাখিয়াছেন। তিনি বলিলেন, “যেহেতু ৮৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ, তাই তাহাদের আর পুলিশি নিরাপত্তার প্রয়োজন নাই। বরং ওই ১৫ শতাংশ নাগরিক, যাহারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেছে, তাহাদের প্রত্যেককে একটি করিয়া লাইসেন্স করা বন্দুক, দুটি ম্যাগাজিন এবং ১০০ রাউন্ড গুলি দেওয়া হউক। তাইলে তাহারা নিজেরাই আত্মরক্ষা করিতে পারিবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ওই ৮৫ শতাংশ মানুষের এলাকায় মোতায়েন না করিয়া আমাদের এই ১৫ শতাংশের এলাকায় ২৪ ঘণ্টা টহলের ব্যবস্থা করা হউক। তাইলেই দেশে প্রকৃত শান্তি আসিবে।”

এই প্রস্তাবের পর সরকারের পক্ষ হইতে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয় নাই। তবে একটি গোপন সূত্রে জানা গিয়াছে, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিতেছে এবং ওই ১৫ শতাংশ নাগরিককে খুঁজিয়া বাহির করিয়া কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য আরেকটি নতুন জরিপ প্রকল্পের কথা ভাবা হইতেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *