উদীচী-ছায়ানটে হামলা থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান হাই কমিশন ঘেরাও, সবই কি শুধুমাত্র সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি হত্যার ক্ষোভ? নাকি এই লাশের ওপর দাঁড়িয়ে জামায়াতে ইসলামী দেখছে একাত্তরের বদলা নেওয়ার স্বপ্ন?
নিজস্ব অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা রিপোর্ট: রাজনীতির দাবা খেলায় পিয়াদার জীবন সব সময়ই অনিশ্চিত, কিন্তু সেই পিয়াদার মৃত্যু যে মাঝে মাঝে মন্ত্রী বা রাজার চালের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলেন সম্প্রতি পটল তোলা সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি। জীবিত অবস্থায় ওসমান হাদি ছিলেন জামায়াতের ইসলামির এক অতি সাধারণ লুকায়িত কর্মী, যার কাজ ছিল ১৫-২০ জনের মিছিলে সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে গালাগালি করা আর নেতাদের নির্দেশে এদিক-সেদিক দৌড়ঝাঁপ করা। কিন্তু মৃত ওসমান হাদি এখন মিডিয়ার আর বটের শক্তিতে বলীয়ান, যার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এমন এক যুদ্ধের নীল নকশা তৈরি করেছে, যা শুনলে খোদ নেপোলিয়ান বোনাপার্টও কবর থেকে উঠে এসে নোট নিতেন। রাজনীতি-বিশ্লেষকদের মতে, হাদির এই মৃত্যু কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত ‘প্রজেক্ট শাহাদাত’। দলের থিংক-ট্যাংক বা চিন্তাবিদদের উর্বর মস্তিষ্কে অনেক আগেই এই প্ল্যান খেলা করছিল যে, প্রতিবেশি হিন্দু রাষ্ট্র ইন্ডিয়ার সাথে যুদ্ধ বাধাতে বা যুদ্ধের আবহ তৈরি করতে হলে এবং দেশের ভেতরের সংস্কৃতিমনাদের শায়েস্তা করতে হলে একটা শক্ত অজুহাত দরকার। আর সেই অজুহাত হিসেবেই বেছে নেওয়া হয়েছে হাদিকে। জামায়াত তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ‘নিজেদের লোক মেরে আন্দোলন জমানোর টেকনিক’ অ্যাপ্লাই করেই সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদিকে পরপারে পার্সেল করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য বহুমুখী, এক ঢিলে দুই পাখি নয়, বরং পুরো এক ঝাঁক পাখি শিকার করা। এই পাখিদের তালিকায় আছে, দেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতি, প্রতিবেশী ভারত এবং সুদূরপ্রসারী ‘সেভেন সিস্টার্স’ দখলের দুঃস্বপ্ন।
হাদির জানাজা শেষ হতে না হতেই এই মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপ উন্মোচিত হয়। লাশ দাফনের পরপরই জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের কর্মীদের যে শোক পালন করার কথা ছিল, তা পরিকল্পিত ভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে আছড়ে পড়ে উদীচী এবং ছায়ানটের মতো সংস্কৃতিমনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি মারা গেল রাজনীতি করতে গিয়ে, তার সাথে গান-বাজনা বা রবীন্দ্রসংগীতের সম্পর্ক কী? জামায়াতের লজিক স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড, তাদের মতে, যুদ্ধ শুরুর আগে ঘরের শত্রু বিভীষণদের বিনাশ করা জরুরি। উদীচী আর ছায়ানট বহুদিন ধরেই তাদের ‘জিহাদি জোশ’-এর পথে কাঁটা হয়ে আছে। এরা সকালবেলা পান্তাভাত খেয়ে বৈশাখ বরণ করে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায় এবং তরুণ সমাজকে তলোয়ারের বদলে কবিতার বই হাতে তুলে নিতে শেখায়। এটি তো সরাসরি তাদের এজেন্ডার বিরোধী। তাই হাদির মৃত্যুর শোককে কাজে লাগিয়ে তারা প্রথমেই হামলা চালাল এই ‘সফট টার্গেট’-এর ওপর। একে তারা নাম দিয়েছে ‘সাংস্কৃতিক শুদ্ধি অভিযান’। তাদের ভাষায়, হারমোনিয়ামের প্যাঁক-প্যাঁক আওয়াজ আর তবলার ধিন-ধিন শব্দ যতদিন থাকবে, ততদিন নাকি সেভেন সিস্টার্স বিজয়ের হুঙ্কার ঠিকমতো জমবে না। তাই উদীচীর অফিসে হামলা আর ভাঙচুরকে তারা দেখছে যুদ্ধের ওয়ার্ম-আপ সেশন বা প্রস্তুতি ম্যাচ হিসেবে।
তবে ঘরের ভেতর সংস্কৃতিমনাদের পিটিয়েই কি তাদের আত্মা শান্তি পেয়েছে? একদমই না। তাদের আসল টার্গেট তো বর্ডারের ওপারে। সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদির লাশকে কেন্দ্র করে জামায়াত এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে ইন্ডিয়ান সহকারী হাই কমিশনারের বাসভবনের দিকে। আন্তর্জাতিক কায়দা-কানুন বা ডিপ্লোমেটিক নর্মস-এর তোয়াক্কা না করে তারা যেভাবে সেখানে হামলা চালিয়েছে, এর পেছনে রয়েছে গভীর জিও-পলিটিক্যাল চাল। ইট-পাটকেল ছোড়া, কাঁচ ভাঙা এবং গেট ধরে ঝাঁকাঝাঁকি এসবই ছিল ইন্ডিয়াকে যুদ্ধের জন্য একটি বন্ধুত্বপূর্ণ নিমন্ত্রণপত্র। জামায়াত খুব ভালো করেই জানে, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়, আর সোজা কথায় ইন্ডিয়া যুদ্ধ না করলে তাদের এম্বাসিতে হামলা করতে হয়। এই হামলার মাধ্যমে তারা ইন্ডিয়াকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে, আমরা প্রস্তুত, তোমরা কবে নামবে? হাদিকে হত্যা করার মাধ্যমে দলের কর্মীদের মধ্যে যে ‘রিভেঞ্জ মুড’ তৈরি করা হয়েছে, সেটাকে এখন চ্যানেল করা হচ্ছে ইন্ডিয়ার দিকে। কর্মীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে এই বলে যে, হাদির মৃত্যুর বদলা নিতে হলে শুধু দেশের ভেতর চেঁচামেচি করে লাভ নেই, বরং দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপন ধরাতে হবে। আর সেই কাঁপন ধরানোর প্রথম ধাপ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সহকারী হাই কমিশনারের বাসভবন।
এই নাটকের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এবং সিনেমাটিক অংশটি মঞ্চস্থ হয়েছে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের সামনে, যেখানে কর্মীদের গগনবিদারী স্লোগান ছিল “বাবরের পথ ধরো, সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করো।” তবে এই হুঙ্কারের শেকড় আসলে মাটির অনেক গভীরে, সোজা চলে গেছে ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলোতে। ইতিহাস সাক্ষী, একাত্তরে ইন্ডিয়া যখন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ আর আওয়ামী লীগকে সাহায্য করে একটি স্বাধীন মানচিত্র উপহার দিচ্ছিল, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত ‘দোস্ত’ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী খেয়েছিল চরম প্যাঁদানি। সোজা বাংলায়, একাত্তরে শুধু পাকিস্তানই হারে নাই, হেরেছিল জামায়াতে ইসলামীও। সেই ঐতিহাসিক পরাজয়ের জ্বালা তারা গত পাঁচ দশকেও ভুলতে পারেনি। তাই তাদের আজন্ম লালিত ফ্যান্টাসি হলো, যেকোনো উপায়ে ইন্ডিয়ার ক্ষতি করে একাত্তরের সেই অপমানের কড়া গণ্ডায় বদলা নেওয়া। আর এই মহৎ(!) কাজে তাদের পেছন থেকে অনবরত জ্বালানি দিয়ে যাচ্ছে তাদের পুরোনো প্রভু পাকিস্তান সরকার। অভিজ্ঞ মহলের মতে, পাকিস্তান তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জামায়াতকে নিয়মিত ‘ফাইন্যান্সিয়াল’ এবং ‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট’ দিয়ে থাকে, যাতে প্রতিবেশী ইন্ডিয়াকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে না দেওয়া হয়। সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদির লাশকে পুঁজি করে তারা এখন সেই পুরোনো এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চাইছে। তাদের লজিক খুবই সরল, একাত্তরে ইন্ডিয়া পাকিস্তানকে ভেঙে দুই টুকরো করেছিল, এখন হাদির লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তারা ইন্ডিয়ার সেভেন সিস্টার্সকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে সেই পরাজয়ের শোধ তুলবে। হাই কমিশনের সামনের ওই স্লোগানগুলো তাই নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে দেওয়া কোনো আওয়াজ নয়, বরং এটি হলো পাকিস্তানি স্পন্সরশিপে পরিচালিত একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার একটি সংঘবদ্ধ রিহার্সাল।
ইন্ডিয়াকে উস্কানি দেওয়ার এই টেকনিকটি সত্যিই ইউনিক এবং অভিনব। একদিকে মৃত কর্মীর জন্য কান্নাকাটি করে সহানুভূতি আদায় করা, অন্যদিকে সেই কান্নার জল দিয়ে প্রতিবেশীর উঠান ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া। জামায়াত খুব ভালো করেই জানে, ইন্ডিয়া যদি একবার রেগে গিয়ে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তাহলেই তাদের কেল্লা ফতে। তখন তারা বিশ্ববাসীকে বলতে পারবে, “দেখুন, আমরা তো শান্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা আমাদের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।” তখন সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদির ছবি বুকে জড়িয়ে জিহাদের ডাক দেওয়াটা অনেক বেশি সহজ হবে। রাজনীতিতে লাশ সব সময়ই খুব দামী পণ্য, আর সেই লাশ যদি হয় দলের কোনো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর, তবে তার লভ্যাংশ শেয়ার বাজারের চেয়েও দ্রুত বাড়ে। হাদির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জীবিত হাদি হয়তো দলের জন্য মাসে দুশো টাকা চাঁদা তুলতেন, কিন্তু মৃত হাদি এখন দলের জন্য কোটি টাকার পলিটিক্যাল অ্যাসেটে পরিণত হয়েছেন। তাকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী তাদের কর্মীদের চাঙ্গা করছে, ফান্ড কালেকশন করছে এবং সর্বোপরি একটি কাল্পনিক যুদ্ধের স্বপ্নে তাদের বিভোর করে রাখছে। এছাড়া, এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জামায়াত তাদের কর্মীদের একটি বিশেষ মেসেজ দিতে চাইছে, আগামী দিনগুলো হবে সংঘাতের, আর সেই সংঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উদীচী বা ছায়ানটের ওপর হামলা ছিল সেই প্রস্তুতির মহড়া। তারা দেখতে চেয়েছিল, প্রশাসন কতটা দুর্বল এবং তারা কতটা শক্তিশালী। যখন দেখা গেল, গান-বাজনার দলকে পিটিয়ে তারা পার পেয়ে গেছে, তখন তাদের সাহস বেড়ে গেছে বহুগুণ। সেই সাহসেই তারা হাত বাড়িয়েছে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের দিকে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওসমান হাদির মৃত্যু কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এটি একটি মাল্টি-লেয়ারড পলিটিক্যাল প্রজেক্ট। প্রথম স্তরে, নিজেদের কর্মীকে সরিয়ে দিয়ে দলের ভেতর আবেগের জোয়ার তৈরি করা। দ্বিতীয় স্তরে, সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে দেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতি বা উদীচী-ছায়ানট মার্কা ‘সফট পাওয়ার’ ধ্বংস করে একটি মননশীলতার ভ্যাকুয়াম তৈরি করা। তৃতীয় স্তরে, ইন্ডিয়ান মিশনে হামলা করে একটি কূটনৈতিক সংকট তৈরি করে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এবং চূড়ান্ত বা ফাইনাল স্টেজে, সেভেন সিস্টার্স দখলের স্লোগান দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়া। এই পুরো পরিকল্পনার কেন্দ্রে আছে একজন মৃত মানুষ, সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি।
ইতিহাস সাক্ষী, বড় কোনো পরিবর্তনের জন্য সব সময়ই কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা হতে হয়। এবার সেই মহান দায়িত্ব (অনিচ্ছাসত্ত্বেও) পালন করলেন সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি। তার রক্তে ভিজে যাওয়া মাটি এখন উর্বর হয়েছে উগ্রবাদের ফসলের জন্য। জামায়াতে ইসলামী এখন সেই ফসলের অপেক্ষায় বসে আছে। হাদির লাশ এখন আর কবরে নাই, সেটি এখন রাজনীতির টেবিলের সবচেয়ে দামী ফাইল, যার প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা আছে বাংলাদেশকে ধ্বংসের নীল নকশা আর ক্ষমতার লোলুপ সমীকরণ। তবে একটা কথা নিশ্চিত, মরা হাতির দাম লাখ টাকা হলেও, মরা হাদির দাম এখন কোটি টাকার রাজনীতি। আর এই রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হতে যাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ, সংস্কৃতি এবং প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক। কিন্তু তাতে কার কী আসে যায়? খেলা যখন ক্ষমতার, তখন পিয়াদার জীবন তো যাবেই, আর সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি তো ছিল কেবলই এক নগণ্য পিয়াদা।
#Cartunus Daily, #অন্তর্বর্তী সরকার, #আমরা সবাই বাবর হবো, #ইন্ডিয়ান হাই কমিশন ঘেরাও, #উদীচীতে হামলা, #একাত্তরের বদলা, #ওসমান হাদি ইনকিলাব মঞ্চ, #ওসমান হাদি হত্যা, #কার্টুনুস ডেইলি, #জামায়াতে ইসলামীর চক্রান্ত, #জিহাদি জোশ, #দৈনিক কার্টুনুস, #নব্য রাজাকার, #পাকিস্তান সেনাবাহিনী, #ফলস ফ্লাগ অপারেশন, #বাবরের পথ ধরো, #বাংলাদেশ ভারত যুদ্ধ, #ভারত বিরোধী উস্কানি, #রাজাকার, #লাশের রাজনীতি, #শরিফ ওসমান হাদি, #সহকারী হাই কমিশনারের বাসভবনে হামলা, #সাউয়া ছেঁড়া ওসমান হাদি, #সাউয়া ছেঁড়া হাদি, #সেভেন সিস্টার্স দখল, #সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করো, #স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, #হাদি হত্যার রহস্য