নিজস্ব প্রতিবেদক: বিগত সপ্তাহে নারী ফুটবল দল বিজয় ছিনিয়ে আনিলে গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যাইবার কথা থাকিলেও, ডিপ স্টেটের চাপিয়ে দেওয়া নয়া নাজেহাল সরকারের সুদক্ষ পরিচালনায় দেশজুড়ে নামিয়া আসিয়াছে শোকের ছায়া। নারীদের খেলাধুলাকে ‘হারাম’ ঘোষণাকারী জঙ্গীগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে ৫ই আগস্ট মেটিকুলাস ডিজাইনে মসনদে বসা নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণ সম্রাট ও গ্রামীণ বেংকের বিশ্ববিখ্যাত সুদগুরু ডক্টর ইউনূসের সরকার এই বিজয়কে দেখিয়াছে ষড়যন্ত্রের কালো মেঘ হিসাবে। বিজয়ী মেয়েদের অভিনন্দনের বদলে তাহাদের চরিত্র ও ভবিষ্যৎ বিবাহ লইয়া গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে সরকারের নবগঠিত ‘খেলাধুলা ও চরিত্র রক্ষা মন্ত্রণালয়’।
মঙ্গলবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা, নব্য ক্রীড়াবিদ্যা বিশারদ, মাঠের চাইতে ওয়াজের ময়দান অধিক পছন্দকারী জনাব আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “অভিনন্দন, আমাদের মেয়েরা জিতেছে। কিন্তু তাতে কী এমন হইয়াছে? তাহাদের এই বিজয় দেখিয়া কোন আলেম সমাজ আগাইয়া আসিয়া তাহাদের বিবাহ করিবে? হাফপ্যান্ট পরিয়া মাঠে দৌড়াইলে বরকতময় পাত্র জুটিবে না। ইহা ইহুদি-নাসারাদের ষড়যন্ত্র।”
হুহু করে কাঁদিয়া ফেলিয়া তিনি বলেন, “এই সকল নারী ফুটবলারদের জন্য আমার রাত্রে ঘুম হয় না। তাহারা দেশের জন্য সুনাম আনিতেছে বলিয়া যে দাবি করা হইতেছে, তাহা সর্বৈব মিথ্যা। বরং তাহারা দেশের যুবসমাজের চরিত্র হনন করিতেছে। আমরা শীঘ্রই নারী খেলোয়াড়দের জন্য ‘ইসলামী ক্রীড়া নীতিমালা-২০২৫’ প্রণয়ন করিতে যাইতেছি।” এই নীতিমালার কয়েকটি ধারা তিনি সাংবাদিকদের নিকট ফাঁস করেন। ধারাগুলো হইল:
১. নারী খেলোয়াড়দের মাথা হইতে পা পর্যন্ত বোরকা পরিয়া মাঠে নামিতে হইবে। কেবল চক্ষু দুইটি খোলা রাখা যাইবে।
২. খেলার মাঠে রেফারির দায়িত্ব পালন করিবেন একজন উচ্চশিক্ষিত মুফতি। তিনি শরিয়া মোতাবেক বাঁশি ফুঁকিবেন।
৩. বলের সহিত খেলোয়াড়ের শারীরিক স্পর্শ যথাসম্ভব কমাইতে হইবে। প্রয়োজনে দূর হইতে ফুঁ দিয়া বলকে গোলপোস্টের দিকে পাঠানো যাইতে পারে।
এই নীতিমালা ঘোষণার পর উপস্থিত সাংবাদিকেরা ‘মারহাবা, মারহাবা’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠেন।
এদিকে, আক্কেলপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধে হামলা চালানোকে একটি ‘সফল জিহাদ’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন তিলকপুর যুব চরিত্র রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও মাঠে হামলা বিশেষজ্ঞ মাওলানা আবুবকর সিদ্দিক। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আমরা শুনিয়াছিলাম মাঠে নারীরা হাফপ্যান্ট পরিয়া একটি গোল বস্তুকে লাথি মারিবে। এই খবর শুনিয়া আমাদের এলাকার যুবসমাজের ঈমানী রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিতে শুরু করে। আমরা বুঝিতে পারি, এই খেলার নামে যুবসমাজের চরিত্র হননের আয়োজন চলিতেছে। তাই আমরা তৌহিদী জনতাকে লইয়া মাঠে গিয়া টিনের বেড়া ভাঙিয়া দিয়াছি। আমরা খেলা বন্ধ করিয়া যুবসমাজকে নিশ্চিত বেহেশতের দিকে এক ধাপ আগাইয়া দিয়াছি।”
এই বিষয়ে আক্কেলপুরের সবকিছু জানি কিন্তু কিছুই জানিনা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মনজুরুল আলমকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি বলেন, “মাঠে বেড়া ভাঙার আগে পর্যন্ত আমি কিছুই জানতাম না। আমারে কেউ কিছু জানায় নাই। আমি মানববন্ধনের পরামর্শ দিই নাই। দিলেও সেটা ঘুমের মধ্যে হইতে পারে। আমার কিছুই মনে নাই।”
এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত জানিতে চাহিলে জাতির সামনে হাজির হন হেফাজতে নাস্তাবুদের নায়েবে আমীর, রয়্যাল রিসোর্টের রঙ্গিলা অতিথি, দ্বিতীয় বিবি বিশেষজ্ঞ ও গজওয়ায়ে সোনারগাঁও-এর মহান সেনাপতি আল্লামা মামুনুল হক রিসোর্টপুরী। এক গোপন স্থান হইতে অনলাইন বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আক্কেলপুরের ভাইয়েরা একটি মডেল জিহাদ সম্পন্ন করিয়াছেন। নারী থাকিবে ঘরের ভিতর, তাহার স্বামী বা পিতার সেবা করিবে। মাঠে গিয়া দৌড়াদৌড়ি করা নারীর কাজ নহে। নারী হইল কোমল, নরম। পুরুষ তাহাকে লইয়া রিসোর্টে যাইবে, আনন্দ করিবে। কিন্তু এই ফুটবলার নারীরা এত শক্তিশালী যে, এদেরকে কাবুতে রাখা যেকোন পুরুষের পক্ষে মুশকিল।ইহারা যদি ইসলামের পথে না আসে, তাহা হইলে ইহাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইহাদের সহিত কোন আলেম বিবাহ করিতে চাহিবে না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই যে নারীরা শর্টস পরিয়া খেলে, ইহা দেখিয়া কোন যুবকের ঈমান ঠিক থাকিতে পারে? পারে না। তাহাদের উচিত বোরকা পরিয়া, স্বামীদের অনুমতি লইয়া কেবল অন্দরমহলের খাটে বিচি দিয়ে মার্বেল খেলা। উহাই যথেষ্ট।”
এই পর্যায়ে আলোচনায় যুক্ত হন হেফাজতে তেঁতুলের প্রতিষ্ঠাতা আমীর ও নারীশিক্ষার ক্লাস ফোর গবেষক, মরহুম আল্লামা তেঁতুল শফী (রহঃ)-এর একনিষ্ঠ মুরিদ, মাওলানা কাজি ইব্রাহিম। তিনি তেঁতুল শফীর অমর বাণী স্মরণ করাইয়া দিয়া বলেন, “হুজুর বলিয়া গিয়াছেন, নারীরা হইল তেঁতুলের মতো। তেঁতুল দেখিলে যেমন পুরুষের জিভে জল আসে, তেমনি হাফপ্যান্ট পরা নারী ফুটবলার দেখিলে পুরুষের ঈমানে ধস নামে। ক্লাস ফোরের বেশি পড়াই যেহেতু জায়েজ নাই, সেখানে ফুটবল খেলা তো অনেক দূরের বিষয়। এই সকল নারীরা তেঁতুলের চাইতেও টক। ইহারা দেশের ঈমানী পরিবেশকে দূষিত করিতেছে।”
তিনি দাবি করেন, “নারী ফুটবলারদের বল লাথি মারার কারণে দেশে ভূমিকম্প ও বন্যার প্রকোপ বাড়িয়া গিয়াছে। তাহাদের প্রত্যেকটি লাথিতে আরশ কাঁপিয়া উঠে। অবিলম্বে এই খেলা বন্ধ না করিলে গজব নামিয়া আসিবে।”
দেশের এই ক্রান্তিকালে জাতির অভিভাবক, নয়া নাজেহাল সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা একটি চরিত্রবান ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন করিতে চাই। নারী ফুটবল একটি সামাজিক ব্যবসা হইতে পারে যদি ইহাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়। আমরা নারী ফুটবলারদের জন্য ‘মাইক্রো-বোরকা’ ঋণের ব্যবস্থা করার কথা ভাবিতেছি। এই ঋণ লইয়া তাহারা শরিয়া-সম্মত পোশাক কিনিয়া মাঠে নামিতে পারিবে।” আক্কেলপুরের হামলা বিষয়ে প্রশ্ন করা হইলে তিনি চোখ টিপিয়া বলেন, “ইহা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ইহার পিছনে একটি অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষের হাত থাকিতে পারে, যাহারা আমাদের সরকারের সাফল্যকে সহ্য করিতে পারিতেছে না। আমরা বিষয়টি খতাইয়া দেখিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘সামাজিক ব্যবসা তদন্ত কমিটি’ গঠন করিয়াছি।”
সবকিছু মিলিয়া, নারী ফুটবলাররা এখন উভয় সংকটে। একদিকে তাহাদের হাতে বিজয়ের ট্রফি, অন্যদিকে সরকারের পক্ষ হইতে বিবাহ না হইবার ভয় ও বোরকা পরার ফতোয়া। মাসের পর মাস বেতন না পাওয়া খেলোয়াড়দের আবাসনের সমস্যার বদলে এখন তাহাদের চরিত্র লইয়া গবেষণা চলিতেছে। শোনা যাইতেছে, বাফুফেকে বিলুপ্ত করিয়া শীঘ্রই ‘বাংলাদেশ ফতোয়া ও ফুটবল ফেডারেশন’ গঠন করা হইবে, যাহার সভাপতি হইবেন আল্লামা মামুনুল হক রিসোর্টপুরী।