১৫ সেনা কর্মকর্তার বিচার: জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোটি টাকার প্রশ্ন।
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: রাজধানী ঢাকার বাতাস আজ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এক অজানা আশঙ্কায় ভারী হয়ে উঠেছিল। কাকরাইল, মৎস্য ভবন থেকে পল্টন পর্যন্ত সড়কের মোড়ে মোড়ে আইনরক্ষকদের উর্দি আর সাঁজোয়া যানের বহর দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের আগমন উপলক্ষে এই এলাহি আয়োজন, অথবা হয়তো কোনো মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এই সাজ সাজ রবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামের একটি পুরোনো দালান, যেখানে আজ ইতিহাসের এক অভিনব বিচারনাট্য মঞ্চস্থ হতে চলেছে। ভোরের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিচ্ছিল আইনরক্ষকদের ভারী বুটের শব্দ আর ওয়্যারলেসের কর্কশ আওয়াজ।
সকাল ঠিক সোয়া সাতটার কাঁটায়, যখন শহরের বেশিরভাগ মানুষ ঘুমের আবেশে বা চায়ে প্রথম চুমুক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই ‘বাংলাদেশ জেল’ লেখা একটি ঝকঝকে নতুন সবুজ রঙের গাড়ি এসে আদালতের গেটে থামল। গাড়িটি এতটাই নতুন আর চকচকে যে, দেখে মনে হচ্ছিল কোনো ভিআইপি বিয়েবাড়ির বরযাত্রী বহন করে আনা হয়েছে। কিন্তু না, সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িটি থেকে একে একে নামানো হলো দেশের পনেরোজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে। তাদের চোখেমুখে কোনো ভয় বা অনুশোচনার চিহ্ন ছিল না, ছিল একরাশ নীরব প্রশ্ন।
কাগজে-কলমে তাদের বিরুদ্ধে গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর সব অভিযোগের পাহাড় দাঁড় করানো হয়েছে; এমন সব অভিযোগ, যা শুনলে যেকোনো সাধারণ নাগরিকের মনে ঘৃণা ও ভয়ের উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক চাল। এই অভিযোগগুলো আদতে একটি সুকৌশলে বোনা জাল, যার মূল উদ্দেশ্য হলো একটি বৈধ সরকারকে সাংবিধানিকভাবে সমর্থন দেওয়াকে আইনের মারপ্যাচে ফেলে শাস্তি দেওয়া।
এর পেছনের প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০২৪ সালের জুলাই দাঙ্গার সেই ক্রান্তিকালে এই সেনা কর্মকর্তারা কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত না করে নিজেদের শপথ রক্ষা করেছিলেন। যখন একটি বৈধ ও নির্বাচিত সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং সরকারপ্রধানকে হত্যার উদ্দেশ্যে সারাদেশে নৈরাজ্য চালানো হচ্ছিল, তখন তাঁরা কোনো গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত হাতিয়ার না হয়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোকেই আগলে রাখার চেষ্টা করেন। তাঁদের মূল ‘অপরাধ’ ছিল এই পেশাদারিত্ব; আর তাঁদের ‘বিচ্যুতি’ ছিল সংবিধানের প্রতি অবিচল থাকা।
জুলাই দাঙ্গার পর ক্ষমতার যে নতুন কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়েছে, তাদের কাছে সাংবিধানিক আনুগত্যই হলো সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহিতা; বিশেষ করে যখন সেই আনুগত্য হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে পরাজিত করে অর্জিত ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রতি। এই নতুন শাসকেরা, যারা রাজনৈতিক আদর্শে পাকিস্তানপন্থী ভাবধারারই উত্তরসূরি, তারা বাহাত্তরের সেই সংবিধানকে বড্ড ভয় পায়। তাদের আশঙ্কা, যে সংবিধান এই রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে, সেই সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যেকোনো কর্মকর্তাই তাদের অবৈধ ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এবং তাদের ক্ষমতাচ্যুতির কারণ হতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, এই বিচার প্রক্রিয়ার আড়ালে রয়েছে আরও গভীর ও সুদূরপ্রসারী এক উদ্দেশ্য। এই অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীকে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে রূপান্তরিত করে নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার রক্ষাকবচ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। তাদের লক্ষ্য এমন একটি বাহিনী তৈরি করা, যার বাহ্যিক কাঠামো থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো মেরুদণ্ড থাকবে না; যে বাহিনী সংবিধানের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাকেই বেশি প্রাধান্য দেবে এবং জাতীয় নিরাপত্তার পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
এই বিচারিক প্রক্রিয়াটি সেই লক্ষ্য পূরণের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভেতরে একটি শীতল বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে যে, সংবিধান বা রাষ্ট্রীয় শপথের চেয়ে বর্তমান কর্তৃপক্ষের প্রতি নিঃশর্তভাবে আনুগত্যই পেশাগত অগ্রগতির এবং টিকে থাকার একমাত্র চাবিকাঠি। যে সকল কর্মকর্তা দেশপ্রেম, সংবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার মতো বিষয়গুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, তাদের ভবিষ্যৎ হবে এই পনেরোজন কর্মকর্তার মতোই অন্ধকার।
আদালতের কার্যক্রম শেষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমের কাছে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন। তিনি জানান, ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের কোথায় রাখা হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কারা কর্তৃপক্ষ। এর বিপরীতে, আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জোরালোভাবে দাবি করেন যে, তার মক্কেলরা নির্দোষ এবং তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।
এই সব নাটকীয়তা, অভিযোগ আর পাল্টা যুক্তির ভিড়ে যে প্রশ্নটা এখন কোটি টাকার চেয়েও অনেক বেশি দামি হয়ে বাংলাদেশের বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা হলো, যদি একটা বৈধ ও নির্বাচিত সরকারকে সাংবিধানিকভাবে সমর্থন দেওয়ার অপরাধে দেশের বীর সেনা কর্মকর্তাদের এভাবে জেলে যেতে হয়, এমনকি ফাঁসির মঞ্চেও ঝুলতে হয়, তাহলে বর্তমান উর্দিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, মহাপরাক্রমশালী সেনাপতি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাহেবের কী হবে?
তিনি তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট একটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকারকে দিনরাত অক্লান্তভাবে পাহারা দিয়ে রেখেছেন। সংবিধানকে বুটের তলায় পিষে একদল দাঙ্গাবাজকে ক্ষমতার মসনদে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ও তার অনুগতরা যে পরিমাণ লালা ঝরানো আর পা চাটার শিল্প প্রদর্শন করছেন, তা যেকোনো বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জয়ের দাবিদার। যদি সংবিধান মানা অপরাধ হয়, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘন করে একটি অবৈধ সরকারের সেবা করা কোন ধরনের ‘মহাপুণ্যকর্ম’?
সেই সহজ হিসাবে, এই পনেরোজন কর্মকর্তার যদি সংবিধান রক্ষার ‘অপরাধে’ একবার করে ফাঁসি হয়, তাহলে সংবিধান অমান্য করে একটি অবৈধ সরকারকে টিকিয়ে রাখার ‘মহাপুণ্য’ কাজের জন্য বর্তমান সেনাপতি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাহেবের কতবার ফাঁসির দড়িতে ঝোলা উচিত? জাতির মেধাবী গণিতবিদরা এই জটিল অংকের হিসাব কষতে গিয়ে ক্যালকুলেটরের বোতাম টিপে শেষ করতে পারছেন না। শোনা যাচ্ছে, এই হিসাব মেলানোর জন্য নাকি সুপার কম্পিউটার ভাড়া করার চিন্তাভাবনা চলছে। দেশের জনগণ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই অংকের চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য। তারা জানতে চায়, আনুগত্যের পুরস্কার যদি হয় বিচার, কারাগার আর, ফাঁসি তাহলে নির্লজ্জ পদলেহনের পুরস্কার কী হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ইতিহাসের কোনো এক পাতায় লেখা হবে, কিন্তু সেই পাতাটি উল্টানোর সাহস কার হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বৈধ সরকারের আনুগত্য আর সংবিধান মানার অপরাধে বিচার শুরু হওয়া ১৫ সেনা কর্মকর্তা কারা?
যে সকল সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তারা রয়েছেন। সেনা হেফাজতে থাকা এই কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), এবং র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম। এছাড়াও আরেকটি মামলায় সেনা হেফাজতে আছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিনজন পরিচালক—মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
#১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির, #১৫ সেনা কর্মকর্তার বিচার, #Cartunus Daily, #অন্তর্বর্তী সরকার, #আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, #ওয়া, #ওয়াকার উজ জামান, #কার্টুনুস ডেইলি, #ক্ষমতার অপব্যবহার, #গুমের মামলা, #জুলাই অভ্যুত্থান, #জুলাই দাঙ্গা, #ড. ইউনূস, #ডিজিএফআই, #দৈনিক কার্টুনুস, #প্রহসনের বিচার, #বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, #মানবতাবিরোধী অপরাধ, #রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, #র্যাব, #সংবিধান লঙ্ঘন