গোপালগঞ্জ গণহত্যা: একটি এপিসি, পাঁচটি লাশ এবং কিছু পলায়নপর নেতা

ঘাতক যখন ত্রাতা: একটি এপিসি, পাঁচটি লাশ এবং কিছু পলায়নপর নেতা। When the Killer is the Savior: One APC, Five Corpses, and Some Fugitive Leaders. ঘাতক যখন ত্রাতা: একটি এপিসি, পাঁচটি লাশ এবং কিছু পলায়নপর নেতা। When the Killer is the Savior: One APC, Five Corpses, and Some Fugitive Leaders.

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কার্টুনুস: একটি প্রাচীন প্রশ্ন রহিয়াছে, ডিম আগে না মুরগি আগে? তবে গোপালগঞ্জ গণহত্যার রক্তাক্ত ষোলই জুলাইয়ের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিধানে একটি নতুন প্রশ্ন যুক্ত হইয়াছে, জনগণ আগে না এনসিপি আগে? প্রশ্নটি আরও সহজ করিয়া বলা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রক্ষক, নাকি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামক একটি সদ্য গঠিত পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও পরিবহন সংস্থা? একই দিনে, একই স্থানে, একই উর্দি পরিহিত একটি বাহিনী কীভাবে যুগপৎ ঘাতক ও ত্রাতার ভূমিকা পালন করিতে পারে, তাহা লইয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এখন চুল ছিঁড়িতেছেন আর আমরা আমজনতা কেবল ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া দেখিতেছি।

ঘটনার সারসংক্ষেপ অতি সাধারণ। এনসিপি নামক একদল ‘দেশ গড়ার কারিগর!’ জাতির পিতার কবর ‘সংস্কার’ করিতে গিয়া গোপালগঞ্জের জনতার ধাওয়ার মুখে পড়ে। সেই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিতে সেনাবাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করিয়া পাঁচটি তাজা প্রাণ কাড়িয়া নেয়। আবার কয়েক ঘন্টা পরেই সেই একই সেনাবাহিনী এনসিপির পলায়নরত নেতাদের উদ্ধার করিতে নিজেদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সাঁজোয়া যান (এপিসি) পাঠাইয়া দেয়। এই ঘটনাকে কী বলিব? পেশাদারিত্ব? নাকি নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব?

আসুন, আমরা সেনাবাহিনীর এই দ্বৈত সার্ভিস প্যাকেজটি একটু বিশ্লেষণ করি।

সার্ভিস প্যাকেজ-১: ‘জনতার জন্য বুলেট এই প্যাকেজটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হইয়াছে সেই সকল ‘বাড়াবাড়ি!’ করা জনগণের জন্য, যাহারা দেশের ‘বিশিষ্ট’ রাজনৈতিক নেতাদের ‘গণতান্ত্রিক’ কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করে। গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, জনগণ যখন তাহাদের নেতার কবরের সম্মান রক্ষার্থে মানবঢাল তৈরি করিয়াছিল, তখন সেনাবাহিনী তাহাদেরকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছে। আর সেই উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের জন্য তাহাদের রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার হইতে বরাদ্দকৃত বুলেট সরাসরি বুকে চালাইয়া দিয়াছে। তাহাদের যুক্তি পরিষ্কার, দেশের আইনের চোখে কবর ভাঙার চেষ্টার চাইতে কবর বাঁচানোর চেষ্টা বড় অপরাধ। এই প্যাকেজের মূল বার্তা হইল, ‘পাকিস্তানপন্থী নেতাদের পিছনে লাগিলে, জীবনের সুইচ অফ করিয়া দেওয়া হইবে।’

সার্ভিস প্যাকেজ-২: ‘নেতার জন্য উবার’ এই প্যাকেজটি ভিভিআইপি গ্রাহকদের জন্য সংরক্ষিত। যাহারা ‘দেশ গড়িতে’ গিয়া গণপিটুনির শিকার হইবার উপক্রম হন, তাহাদের জন্য রহিয়াছে এই বিশেষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন সেবা। গোপালগঞ্জে যখন জনতার ভালোবাসার তাপে এনসিপির নেতাদের পশ্চাৎদেশ পুড়িয়া যাইবার দশা, তখন সেনাবাহিনীর তরফ হইতে আসিয়াছে এপিসি নামক রাজকীয় বাহন। এই প্যাকেজের আওতায়, পলায়নরত অবস্থায় দেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা, এপিসি-আরোহী বিপ্লবী, এবং সেনাবাহিনীর কাঁধে চড়িয়া মুজিববাদ হটানো বীর যোদ্ধা জনাব নাহিদ ইসলাম এবং তাহার তিন রত্ন সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, ও আখতার হোসেনকে পরম যত্নে ও নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। তাহাদের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগিতে দেওয়া হয় নাই। কারণ তাহারা সাধারণ জনতা নহেন, তাহারা ‘ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক’। তাহাদের জীবনের মূল্য পাঁচটি সাধারণ জীবনের চাইতে অনেক বেশি।

এই দ্বৈত ভূমিকা দেখিয়া জাতির মনে আজ বড় প্রশ্ন। দেশের সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনী কাহার? দেশের সকল নাগরিকের, নাকি বিশেষ কোনো দলের? মাননীয় সেনাপ্রধানের নিকট জাতি জানিতে চায়, আপনাদের এপিসির সিটের তলায় কি লেখা আছে যে, ‘শুধুমাত্র এনসিপি নেতাদের জন্য সংরক্ষিত’? আপনারা কি এখন হইতে রাজনৈতিক দলের বিবাদ মীমাংসার জন্য ‘এক পক্ষকে গুলি করো, আরেক পক্ষকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দাও’ এই যুগান্তকারী নীতি গ্রহণ করিয়াছেন? যদি তাই হয়, তবে সেনাবাহিনীর নাম পরিবর্তন করিয়া ‘এনসিপি নিরাপত্তা ও পরিবহন লিমিটেড’ রাখা হউক।

এই প্রহসনের মঞ্চে সবচেয়ে করুণ চরিত্রটি হইলেন দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোসফেকুর রহমান। বেচারা শুধু ফেসবুকে এই এপিসি-বিলাস লইয়া একটি নিরীহ রসিকতা করিয়াছিলেন: “ট্যাংকের এসি খুব আরামদায়ক শুনেছি।” আর যাইবেন কোথায়! যেই দেশে ঘাতক আর পলায়নপর নেতারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পায়, সেই দেশে রসিকতা করা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে। অর্থাৎ, এই রাষ্ট্র আমাদের শিখাইতেছে যে, তুমি নিরস্ত্র মানুষ মারিতে পারো, রাজনৈতিক তাণ্ডব চালাইতে পারো, জনতার ভয়ে ট্যাংকে লুকাইতে পারো কিন্তু খবরদার, এই সকল বিষয় লইয়া কৌতুক করিতে পারিবে না। কারণ বন্দুকের নলের চাইতে রসিক লোকের কলম বা কি-বোর্ড এখন বেশি বিপজ্জনক।

আমরা জনাব নাহিদ ইসলামের নিকট কৃতজ্ঞ। তিনি অন্তত স্বীকার করিয়াছেন যে তাহারা ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা’ মেনেই চলিয়াছেন। এখন প্রশ্ন হইল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ট্যাক্সি সার্ভিস চালাইবার নির্দেশনা নাহয় যমুনা হইতে ড. ইউনূস দিয়াছেন, কিন্তু নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালাইবার নির্দেশনা কে দিল? এই নির্দেশনার উৎস কোথায়? আপনাদের নিয়োগকৃত ইউনূস সাবেহই?

যতদিন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না মিলিবে, ততদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উর্দি পরা প্রতিটি সদস্যকে দেখিয়া সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়িবে, ইহারা কি আমাদের রক্ষক, নাকি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর ভাড়াটিয়া বাহক? ষোলই জুলাই গোপালগঞ্জ গণহত্যা তাই শুধু পাঁচটি প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি কালো দিন নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠানের নৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙিয়া পড়ারও দিন।

#, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #, #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *